জীবনের ক্যানভাস জুড়ে কতো স্বপ্নেরা জোনাকির আলোর মতো কতো রঙের খেলায় আঁকিবুঁকি কাটে। তাদের পাখায় ভর দিয়ে ইচ্ছেরা ডানা মেলে। তাদের মৃদু আলোয় অনেক স্মৃতিতে ভরা রূপকথার গল্পেরা ফুটে ওঠে বাস্তবের পটে। আলো-আঁধারির বুকে তারা এঁকে চলে বিচিত্র রঙের আলপনা। মনের মাধুরী মেশা কল্পনায় তারা ফুটে ওঠে আলোর পালক হয়ে। এমনি রঙীন প্রেমকাহিনী ছিলো টিকলি আর বাপ্পার। কিন্তু এই মধুর প্রেমের এমন করুণ পরিণতি হবে তা কে জানতো!
ভালোবেসে কি তবে ভুল করেছিলো টিকলি?
কিন্তু ভুলটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল তা কখনো স্পষ্ট করে বোঝাতে পারেনি বাপ্পা। আজ প্রায় আট বছর হয়ে গেলো ওদের সম্পর্কের। এই আট বছরে বাপ্পার ভালোবাসা টিকলির জীবনকে করেছে পরিপূর্ণ। কিন্তু এই আট বছর পর বাপ্পার এই কঠিন সিদ্ধান্ত টিকলিকে করেছে দিশেহারা।
টিকলির ভাই পিকলুকে পড়াতো বাপ্পা। সেই সূত্রে আলাপ হয় দুজনের। ধীরে ধীরে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ওদের। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব খুব বেশিদিন কেবলমাত্র বন্ধুত্বের জায়গায় সীমাবদ্ধ রইলো না। টিকলি আর বাপ্পার বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখন কিভাবে যে প্রণয়ের বন্ধনে জড়িয়েছিল তা বোঝেনি দুজনের কেউই। সম্পর্কের কয়েক মাসের মধ্যেই বাপ্পা অনুভব করতে থাকে যে তার এবং টিকলির জীবনশৈলির মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রথমদিকে এই তফাৎগুলো কখনো ধরা পড়েনি। তখন কেবল মিলগুলিই চোখে পড়েছিল, যেগুলি বেঁধেছিল দুজনের দুটি মনকে। ক্রমে যতই অমিলগুলি ধরা পড়তে লাগলো, সেই পার্থক্যগুলোকে বাপ্পা কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সে সবসময় এই সম্পর্কে একটা হীনমন্যতা অনুভব করতো। তার নিজেকে কেবলই টিকলির অযোগ্য মনে হতে লাগলো। সে চেয়েছিল এই সম্পর্কের ইতি টানতে কিন্তু টিকলি বাধা দিয়েছিলো বারবার। বাপ্পাকে ছাড়া বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। আর বেঁচে থাকলেও সেই বাঁচার অর্থ হবে একটা মৃত মন নিয়ে বেঁচে থাকা। টিকলির মনে তিলতিল করে জন্ম নেওয়া একরাশ স্বপ্নের হত্যাকারী হতে চায়নি বাপ্পা। বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছে সে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে। টিকলিকে চরম মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। সেই যন্ত্রণা থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে টিকলি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে কি ঘৃণা করা যায়? তার থেকে দুরে চলে গিয়ে তাকে চিরতরে ভুলে থাকা যায়? নাহ, পারেনি দুজনের কেউই একে অপরকে ছেড়ে থাকতে। অনেক ঝগড়া হয়েছে দুজনের। আবার তারা সেসব মিটিয়েও নিয়েছে। আসলে বাপ্পা একটু মাথাগরম প্রকৃতির হলেও টিকলি ছিল ভারী মিষ্টি আর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। টিকলি বাপ্পাকে অনেক বুঝিয়ে সবকিছু সামলে নিতো। বাপ্পার অনেক অপমান সহ্য করেও টিকলির মন থেকে ভালোবাসা একচুল পরিমাণও কমেনি। তবে বাপ্পা টিকলির অনেক ইচ্ছে পূরণ করতো। ওকে শহরের অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। ছোট ছোট অনেক ইচ্ছে পূরণ করতো। টিকলির খুব খেয়াল রাখতো, খুব আগলে রাখতো টিকলিকে। কোনোদিন টিকলির অযত্ন করেনি বাপ্পা। টিকলির অনেক সময় রাতে ঘুম না এলে বাচ্চাদের মতো গল্প বলে, গান করে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। টিকলি বলতো যে ওর মায়ের পর কেউ যদি ওকে সবচেয়ে ভালো বোঝে, সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয় আর সব বাচ্চামো সহ্য করে, তবে সে হলো একমাত্র বাপ্পা। টিকলি ছবি তুলতে খুব ভালোবাসতো। কোথাও ঘুরতে গেলে ছবি তুলতে বলে পাগোল করে দিতো বাপ্পাকে। তবে বাপ্পা পরম ধৈর্য সহকারে তার সব ছেলেমানুষি সহ্য করতো। কখনো রাগতো না। আবার অনেক সময়ে টিকলির কিছু ভুলের জন্য সাংঘাতিক রেগে যেত বাপ্পা; কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতো বেশ কিছুদিন। আবার সব ঠিক হয়ে যেতো ধীরে ধীরে। এইভাবেই সুখে-দুখে, ঝগড়ায়-ভালোবাসায়, শাসনে-সোহাগে কেটে গেল আট আটটা বছর।
এই আট বছরেও কোন চাকরী জোটাতে পারেনি বাপ্পা। প্রতিষ্ঠিত না হয়ে কি করে সংসার করবে টিকলিকে নিয়ে? কিছু ঘর বাঁধার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়। বাপ্পা পারেনি টিকলিকে তার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে। টিকলিকে এক আকাশ ভালোবাসা দিতে পারলেও এক ছাদের নীচে একটা ছোট্ট সংসার দিতে সে ব্যর্থ। বাপ্পার মনের কিছু জটিল ভাবনা এর জন্য দায়ী। যার কাছে হার মানতে বাধ্য হলো টিকলির সংসার করার ইচ্ছে। মনের মিল থাকলেও ওদের মতের অমিল ছিল মাত্রাছাড়া। তাছাড়া, টিকলির বেশ কিছু সখ, অভিরুচি ও মনোভাব বাপ্পার খুব অপছন্দ ছিল। সেগুলো সে কখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, আবার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে ভেবে কখনো বাধাও দিতে পারেনি টিকলিকে। তাই ওদের প্রণয় কখনো পরিণয়ের রূপ পেলো না। প্রেয়সী হয়েও টিকলি আজীবন বাপ্পার অপরিণীতা হয়েই রইলো।
কিন্তু, এখানেই এই গল্পের শেষ নয়। এক বছর বাদে বাপ্পা হঠাৎ জানতে পারলো টিকলির শরীরে বাসা বেঁধেছে এক দুরারোগ্য ব্যধি। টিকলির হাতে সময় মাত্র কয়েক মাস। টিকলি চলে যাওয়ার আগে বাপ্পাকে জানায় তার শেষ ইচ্ছা, সে চায় তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। টিকলির শেষ ইচ্ছে রাখতে বদ্ধ পরিকর বাপ্পা কারণ টিকলি যে তার প্রাণাধিক প্রিয়।
~ শৌভিক রায়
© Copyright Protected
© Copyright Protected
1 Comments
Darun ....
ReplyDelete