লেখার পরেই অপর্ণার মধ্যে একটা যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গেল। কিছুটা অজানাকে জানার কৌতূহল, কিছুটা নতুন কিছুর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ভয় তার মনকে বার বার নাড়া দিয়ে তুলছিলো।
যথাসময়ে মিঃ বোস বাড়িতে এসে উপস্থিত। আলাপচারিতা শেষে শুরু হলো অপর্ণার ট্রেনিং। প্রথমে শুরু হলো ইংরেজিতে অনর্গল কিভাবে কথা বলতে হয় তার ট্রেনিং। অপর্ণা ইংরেজি ভাষাটা জানলেও ইংরেজিতে কথা বলতে একটু ভয় পায়। আসলে ছোটবেলায় একবার স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলার সময় একটু ভুল বলায় তাকে নিয়ে তার বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করেছিল। তার পর থেকেই ইংরেজিতে কথা বলার ভয়টা তার মনের মধ্যে বেশ জমিয়ে বাসা বেঁধেছে। এতদিন পর তার মনের মধ্য থেকে সেই ভয়ের বাসা ভেঙে ভয়কে উচ্ছেদ করা যাবে কিনা সেটা নিয়েই হাজার রকম ভাবনা কাজ করেছে অপর্ণার মধ্যে। এতক্ষণ তবু প্রতুল পাশে বসে থাকায় মনে একটু সাহস জুগিয়ে শেখার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু হঠাৎ একটা ফোন আসার পর তাড়াহুড়ো করে প্রতুলের বেড়িয়ে যাওয়ার পর অপর্ণার মনের ভয়টা যেন আরও শক্ত করে নিজের বাসখানা গুছিয়ে নিল। এই মুহূর্তে প্রতুলের তো ওর সাথেই থাকার কথা। কিন্তু এইভাবে ওকে একা ফেলে চলে চাওয়াটা যেন মেনে নিতে পারছেনা অপর্ণা। মোটের ওপর সেদিন সে তেমন কিছুই শিখতে পারলো না। যতটা আশা নিয়ে তার দিনের শুরু হয়েছিলো ততটাই নিরাশার সাথে দিনটা শেষ হলো। তাই ওদিকে ভরে উঠল তার ডায়েরির পাতা-
লেখাতে আজ নেই তো মন,
খাতা কলমও ছিঁড়েছে বাঁধন,
তুই এসে বলবি কখন-
"চিন্তা নেই, আমি আছি তো সারাক্ষণ"।
তার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রতুল পাশে নেই ,বালিশের ওপর একটা ছোট চিঠিতে লেখা-"অফিসের কাজে একসপ্তাহের জন্য পাটনা যাচ্ছি।নিজের খেয়াল রেখো"। চিঠিটা পড়েই অভিমানের পাহাড় তৈরি হলো অপর্ণার মনে।এইভাবে একটা ছোট চিঠি লিখে চলে গেল, একবার তাকে মুখ ফুটে বলে উচিত ছিল।বিছানা ছেড়ে তৈরি হয়ে নেয় ট্রেনিং এর ক্লাসের জন্য।কিন্তু মনটা সারাক্ষন প্রতুলের দিকেই পরে থাকে আর বার বার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রতুলের কল বা মেসেজ এলো কিনা।এদিকের বিকালের দিকে হঠাৎ কালো মেঘ জমে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়।যেন অপর্ণার কষ্ট প্রকৃতিও বুঝতে পারছে তাই সেও অপর্ণার দুঃখে নিজের চোখের জলকে বৃষ্টি হিসাবে ঝরিয়ে দিচ্ছে।অপর্না তার নিত্য সঙ্গী ডায়রি খুলে লিখতে শুরু করে-
"বৃষ্টি মাখা সন্ধ্যা জুড়ে মনে পড়ে তোমায় সারাক্ষন,
অপেক্ষায় থাকি,কখন তোমার আসবে টেলিফোন?"
এইভাবেই একটা একটা করে দিন কাটতে থাকে আর অপর্ণার মনের মধ্যে ভয়ের সাথে হতাশা বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের বাসা শক্ত করে। এখন ইংরেজি শিক্ষার সাথে উচ্চ সমাজে কিভাবে মিশতে হয় তার প্রশিক্ষণও চলছে। ধীরে ধীরে অপর্ণা আর প্রতুলের সম্পর্কের মধ্যে দুরত্ব বেড়েই চলেছে। অপর্ণার প্রতি প্রতুলের কেয়ারিং ভাবটা যে অনেকটাই কমে গেছে সেটা সে ভালোই বুঝতে পারে। এদিকে অপর্ণার খাবারের তালিকায় পরিবর্তন হয়েছে।এখন যা খেতে ইচ্ছা করে কিছুই পায়না তার পরিবর্তে কি সব খেতে দেয় যেগুলো সে আগে কখনো চোখেই দেখেনি,তাতে তার না ভরে পেট আর না ভরে মন। সে ভাবলো তার প্রতি কেয়ারিং ভাবটা হয়তো প্রথম প্রথমই ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে সে কিছুই বলতে পারে না।তার মনের কথার একমাত্র সাক্ষী তার ডায়রি।মনের যত মান,অভিমান, কষ্ট ,সুখ দুঃখের গল্প সব ডায়রির পাতা জুড়ে ভর্তি।ডায়রিতে সে প্রায় প্রতিদিন লেখে তার অভিমানের কথা―
"মান অভিমানের চলছে রেশ ,
কোথাও বা সময় শেষ ,
স্বপ্নের বাড়িতে ধূলো জমছে,
নীরবে মোমবাতি তার প্রহর গুনছে।"
এইভাবেই রেল লাইনের মতো পাশপাশি থেকেও সামন্তরাল ভাবে চলতে থাকে তাদের বিবাহিত জীবন।ছয় মাস কেটে গেল তবু কোনো কিছুই অপর্ণা শিখে উঠতে পারলো না। কিছু শিখতে না পারার কষ্ট তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলেছে। শাঁখের করাতের মতো অপর্ণার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। না পারছে এগিয়ে যেতে আর না পারছে এসব থেকে পিছিয়ে আসতে। যদিও সে একদিন নিজেই চেয়েছিল সমাজে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু এখন তার জীবন এই ট্রেনিং এর যাঁতাকলে পেষা হয়ে যাচ্ছে।আজ তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।একমাত্র তার মা তার মনের কথা না বললেও ঠিক বুঝে যেত।দু চোখে জল নিয়ে ডায়রির পাতায় লিখতে শুরু করে-
"সম্পর্কের টানাপোড়েনে আমিও অবসন্ন,
সময়ের যাঁতাকলে স্মৃতিরাও আজ বিবর্ণ ।"
একদিন হঠাৎ প্রতুল এসে জানালো যে তাদের কোম্পানীর একটা কনফারেন্সের অনুষ্ঠানে অপর্ণাকে ইংরেজিতে একটি বক্তৃতা দিতে হবে। কথাটা শুনেই আঁতকে উঠল অপর্ণা। সে অনেকবার প্রতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সে পারবে না কিন্তু প্রতুল তার কথা শোনার পাত্র নয়।
অগত্যা পরের দিন অপর্ণাকে যেতেই হলো অনুষ্ঠানে কারণ তাকে বক্তৃতা দিতে হবে। কিন্তু সে কি বলবে সেটাই তার মাথায় আসছে না।
যথা সময়ে অপর্ণাকে মঞ্চে ডেকে মাইক দেওয়া হলো। একদিকে ইংরেজিতে কথা বলার ভয় আর অন্য দিকে এত মানুষজনকে দেখে সে এতটাই ঘাবড়ে গেল যে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হয়নি। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
যখন তার হুঁশ ফিরলো মনে মনে খুব দুঃখ পেলো প্রতুলের জন্য। প্রতুল এত আশা নিয়ে ওকে মঞ্চে তুলেছিল, কিন্তু সে নিজের সাথে সাথে প্রতুলেরও মান সম্মান সব ডুবিয়ে দিলো।
বাড়িতে ফিরেই প্রতুল অপর্ণাকে পাশে বসিয়ে রীতিমত জেরা শুরু করলো।
―কি হয়েছে তোমার আজ মঞ্চে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেনো?
―জানি না কেনো।
―কমপক্ষে দু একটা কথাও তো বলতে পারতে। বলোনি কেনো?
―জানি না।
― তোমার কি শরীর খারাপ?
― না।
এতক্ষণ প্রতুল শান্ত ভাবেই প্রশ্ন গুলো করছিলো। কিন্তু অপর্ণার এরকম উত্তর শুনে মাথায় আগুন যেন আগুন জ্বলছে। মেজাজ হারিয়ে উচ্চস্বরেই অপর্ণাকে কথা শোনাতে লাগলো।
―"জানো তোমার এই জানিনা কারণের জন্য আমার কতটা অসম্মান হলো। সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? গত ছয় মাস ধরে তোমাকে মিঃ বোস ট্রেনিং দিচ্ছেন। তুমি কি এতদিনে আমাদের কোম্পানি সম্পর্কে কিছুই বোঝোনি? তোমাকে উচ্চসামাজে কিভাবে মিশতে হয় সে সম্পর্কেও শেখানো হচ্ছে কিন্তু তুমি এতদিনে কিছুই শিখতে পারোনি। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় কিছুই শেখোনি।সেদিন তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে তুমি সব পারবে।কিন্তু এতদিনে এই সামান্য জিনিসটুকু শিখতে পারলে না।"
এতদিনে প্রতুলকে এতটা কোনোদিন রাগতে দেখেনি অপর্ণা। তাই আজ প্রতুলের প্রতিটা কথা যেন তার মনে তীরের মতো বিঁধছিল। তার অজান্তেই চোখের নোনাজল দুগাল বেয়ে বয়ে চলেছে।
"সাহিত্য আমার নেইকো জানা,
বুক জুড়ে শুধু অভিমান মেলে ডানা,
যখন বৃষ্টি হয়ে সে দুচোখ ঝরে-
তখনই মনের কলম মুখ খোলে।"
প্রতুলের মায়ের শরীর অসুস্থ থাকায় তিনি অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। কিন্তু প্রতুলের আওয়াজ শুনে প্রতুলের মা ঘটনার কিছুটা আন্দাজ আগেই পেয়েছেন। তাই কিছু বলবেন বলে দরজার কাছে গিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসেন। কারণ তিনি জানেন তাঁর ছেলে যতটা শান্ত ঠিক ততটাই রাগী।একবার রেগে গেলে তাকে শান্ত করা খুব কঠিন।আবার খুব সহজে নরমও হয়ে যায়।
এদিকে প্রতুল অনর্গল বলেই চলেছে—
― তুমি যেদিন বলেছিলে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও, কিন্তু একটা সুযোগ চাই, তোমাকে সেই সুযোগটা দেওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়েটা করেছিলাম। কারণ আমি আমার কোম্পানিকে বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানি হিসাবে দেখতে চাই। আর আমার কোম্পানিকে প্রেজেন্ট করার জন্য চাই তোমার মতো একজনকে। আমার যে বিউটি প্রোডাক্টের কোম্পানি সেটা তো জানোই। আর এই কোম্পানির স্লোগান হলো "বয়স শুধুমাত্র একটা সংখ্যা। সৌন্দর্যতা সর্বদা বজায় রাখুন।" তুমি খুব সুন্দরী নও কিন্তু তোমাকে সুন্দরী করে বিশ্বের সামনে প্রতিস্থাপন করাই ছিল আমার লক্ষ্য। আর সেটা হলেই আমি আমার কাজে সফল হতাম। কিন্তু তুমি শুধু মুখেই বলো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও, আসলে তুমি কিছুই পারোনা। শুধু শুধু ছয়টা মাস নষ্ট করলে। জানো এই ছয় মাসে বাকি কোম্পানি কতটা এগিয়ে গেছে? তোমাকে আগেই বলেছিলাম কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়।আর পরিশ্রম ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। সব কি ভুলে গেছো?
এতক্ষণে অপর্ণার চোখ দিয়ে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। যেন চোখের জল শেষ হয়ে গেছে। প্রথমে সে প্রতুলের রাগ দেখে কষ্ট পেলেও শেষের কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে কাঠের মতো নীরব হয়ে গেছে। কিন্তু মনের কোণে থাকা এতদিনের কষ্ট ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল—
―"আমি শুধু তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি।"
কথাটা শুনে প্রতুলের মন একটু নরম হলো। একটু হেসে বলল,
―এখনো তুমি সেই ছেলেমানুষই রয়ে গেলে। সশরীরে উপস্থিত থাকলেই পাশে থাকা হয় তা নয়, অন্য ভাবেও পাশে থাকা যায়।
―মানে?
―মানে এই যে গত ছয় মাসে তুমি নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাওনি?আগে বাড়ি ফিরে দেখতাম তুমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। বাড়ি ফিরে আমার ইচ্ছা করত তোমার সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু তুমি সশরীরে আমার পাশে থাকলেও তোমাকে আমার পাশে পাইনি। প্রথমে বুঝতাম না এটার কারণ কি। ভাবতাম আমাকে তোমার পছন্দ না তাই আমার সাথে কথা বলতে চাও না, তাই ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝলাম সারাদিন ট্রেনিং এর ক্লাস করে তুমি ক্লান্ত থাকো তাই ঘুমিয়ে পর। আর সকালে আমি কাজে বেরোনোর পর তুমি ঘুম থেকে ওঠো। তাই তোমার সাথে আমার সেভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শে তোমার খাবারের তালিকার পরিবর্তন করা হয়েছে। মিঃ বোসকে বলে তোমার ট্রেনিং এর সময় কমিয়েছি। মাকে বারবার ফোন করে তোমার খবর নিয়েছি। অনেকবার ভেবেছি তুমি নিজে থেকে এসে বলবে আমি কেন তোমার খবর তোমার কাছ থেকে নিইনা। কিন্তু তুমি আমাকে কিছুই বলোনি।"
বাচ্চারা প্রথম হাতি দেখলে যেমন অবাক হয় অপর্ণা প্রতুলের কথাগুলো অবাক হয়ে শুনছিলো।
ওদিকে প্রতুল বলেই চলেছে–
―তোমাকে বিয়ে করেছিলাম হয়তো শুধু নিজের স্বার্থে, কিন্তু ধীরে ধীরে কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেই বুঝতে পারিনি। অন্যদের মতো ফুলের তোড়া নিয়ে হয়তো তোমাকে কোনোদিন মনের কথা বলতে পারিনি। কিনতু তার মানে এটা নয় যে তোমাকে ভালবাসিনা বা তোমার কথা ভাবিনা, তোমার পাশে নেই।শুধু মুখে ভালোবাসি বললেই কি ভালবাসা হয়?ভালোবাসতে গেলে সুন্দর মন লাগে যেটা তোমার আছে।"
―তুমি কি করে জানলে যে আমার সুন্দর মন আছে?
―যে এত সুন্দর লিখতে পারে তার মন সুন্দর না হয়ে পারে?
―মানে তুমি আমার ডায়রি লুকিয়ে পড়েছ?
―লুকিয়ে পড়তে যাবো কেন? সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম ডায়রিটা পাশে রেখেই ঘুমাচ্ছিলে।হয়তো লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই ভাবলাম একটু পড়ি।
―তা কি পড়লে?
―আমাকে নিয়ে লেখা তোমার অভিমানের কথা।
তারপর প্রতুল ,অপর্ণার ডায়রির পাতায় লেখাগুলো পর পর বলতে থাকে-
"ভালো লাগে যখন তুমি সব কথাতেই লাগাও মাখন,
মনের কোণে মেঘ জমেছে, কিছুটা প্রকাশ্য,কিছুটা একান্ত আপন।"
"দেখ তোর জন্য রোদ্দুর নামিয়ে পর্দা টাঙানো,
কোথাও মন নেই, সবচেয়ে দামি এই কথা জানানো।"
"তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে খুব বাঁচতে ইচ্ছা করে,
কিন্তু তুমি তো নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যস্ত।"
"চারিদিকে এখন প্রেমের মরশুম ,
আর আমি বুনছি বিরহের মাশরুম।"
"রাত্রি হলে নামলে আঁধার,তোমার শহর ব্যস্ত হয় আরো,
তোমায় নিয়ে এত লিখি,একদিন ও কি পড়ো?"
"প্রেমের কথা যতই বলি স্বপ্ন এখন অন্য,
মিলব সেই একই জায়গায় রাস্তা যতই হোক ভিন্ন।"
"অভিমানের অভিযোগ নিয়ে তোমাকে আর দাঁড় করাবো না কাঠগড়ায়, ব্যর্থ আমি ,ভালোবেসে ও আজ আমি অসহায়।"
"খাতা কলম আজ গুনছে প্রহর,
কখন দু কলম লিখবো ভাবে,
আমিও গড়েছি নিজের শহর ,
যেখানে এসে ভালোবেসে তুমি দুহাত বাড়াবে।"
"ভেবেছিলাম তুমি আর আমি লিখবো দু-এক অক্ষর,
এইভাবেই রেখে যাবো আমাদের প্রেমের স্বাক্ষর।"
প্রতুলের কথাগুলো অপর্না হাঁ করে শুনতে থাকে।মাত্র একবার পরেই প্রতুল তার লেখা গুলো মুখস্থ করে ফেলেছে অথচ সে নিজেই ভুলে গেছে সে তার ডায়রিতে কি লিখেছে।আসলে অপার্নার মনে যা আসে তাই ডায়রিতে লিখে রাখে কিন্তু সব মনে রাখতে পারে না।
প্রতুল বলতে থাকে-"এই যে ম্যাডাম, আপনি তো ভালোই লেখেন।কিন্তু ডায়রির পিছনের পাতা যদি একটু উল্টে দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন আমার মনের কথা।"
সঙ্গে সঙ্গে অপর্না ডায়রিটা নিয়ে এসে দেখে ডায়রির পিছনের পাতায় লেখা আছে-
"মন হওয়ায় পেয়েছি তোমার নাম,
জানি না কখন কেনো কিভাবে এতটা ভালবাসলাম।
মনি করে রেখেছি তোমায় চোখের তারায়,
মনের কথা বুঝবে কবে হায়!!"
এখন নিজের ভুল ধারণা ভাঙতেই একটু লজ্জা পেয়ে অপর্ণা মাথাটা নামিয়ে নিলো। এখন নিজের কাছেই খুব ছোট লাগছে নিজেকে। কি যে বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আলতো গলায় বলল
―সরি, আমি সত্যি তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। তোমার চাওয়াকে গুরুত্ব দিতে পারিনি। এবার থেকে শুধু আমার বা তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নয়, আমাদের দুজনের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে তৈরি করব, কথা দিলাম।
প্রতুল অপর্ণার হাত দুটো ধরে বলে উঠল―
"জোনাকিদের আলো নিয়ে সাজাবো আমাদের ঘর;
অবহেলার ব্যাথা জমছে বুকে, এভাবে করে দিওনা পর।"
অপর্ণা প্রতুলের বুকে মুখ লুকালো।
* * * * * *
এক বছর পর―――
আজ অপর্ণা ইতালির কনফারেন্স হলে বক্তৃতা দেবে। এতদিন দেশেই কয়েকটা জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছে এবং যথেষ্ট প্রশংসাও পেয়েছে। কিন্তু আজ বিদেশের মাটিতে প্রথম নিজের বক্তব্য রাখবে, নিজেদের কোম্পানির প্রোডাক্ট নিয়ে। নানা দেশ থেকে আসা গুণী মানুষজন তার কথা শুনবে। প্রথমে একটু ভয় করলেও প্রতুলের হাসি মুখটা দেখে সব ভয় চলে গেল। আসলে মঞ্চে উঠে মানুষজন দেখলেই অপর্ণার মনে যে ভয় ঘুরে বেড়াতো প্রতুলের হাসি সেই ভয়কে তাড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত।প্রতুলের হাসি তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে একসময় তার ডায়রিতে লিখেছিল-"ছোট্ট মনের আকাশমণি,ভিন্নতায় ছোঁয়ালো একফালি হাসি,আমি সেই হাসিতেই পোড়াতে চাই আমার সারাটা বেলা....""
বক্তৃতা শেষে পুরো হল হাততালির শব্দে ভরে গেল যেটার স্থায়িত্ব প্রায় পনেরো মিনিট। এটার পরেই অপর্ণার নাম বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। অপর্ণার নামের মধ্য দিয়েই অপর্ণা আর প্রতুলের স্বপ্নপূরণ হলো।
দিনের শেষে অপর্ণা ফিরে আসে তার সারাজীবনের বন্ধু ডায়েরির কাছে। কলম নিয়ে লিখতে শুরু করে―
"বলেছিলে তোমার ঝাঁ চকচকে শহরে আমি অবাঞ্ছিত আগাছার মতো বেড়ে উঠেছিলাম, তাই তাকে কেটে ফেলা উচিত। ভাগ্গিস সেই ভুল সেদিন করোনি। নইলে আজ যে মানুষগুলো সেই আগাছা থেকে বেড়ে ওঠা মহীরুহের নীচে আশ্রয় খোঁজে তারা আশ্রয়হীন হয়ে যেত।"
অস্মি সেনগুপ্ত ©
0 Comments