পরীক্ষার জন্য অনেকদিন ডায়েরীতে কিছু লেখা হয়নি। আজ লিখতেই হবে, না হলে কোনো কাজে মন বসবে না...... এসব ভাবতে ভাবতে ডায়েরি আর পেনটা নিয়ে বসলো অপর্ণা। বসে কিছু না ভেবেই লিখতে শুরু করলো―
"রূপবতী নই তো আমি, নই তোমার স্বপ্নকুমারি, আমি তো এক কল্পবালা, নতুন পরিচয়েই তাই শুরু করলাম তোমার-আমার গল্পমালা।"
লেখা শেষ করে একবার লেখাটা পড়ে নিয়ে নিজের মনেই হাসলো আর ভাবলো, কিসের গল্প আর কার সাথেই বা গল্প— কি যে লেখে মাঝে মাঝে সে নিজেও জানে না।
অপর্ণার শখ, ইচ্ছা বলতে ওই ডায়েরি লেখা। যখন মনে যা আসে বা নতুন কিছু শিখলেও, সেটা রান্নার রেসিপি হোক বা মেকআপ এর কোনো টিপ্স(যদিও তার রান্না বা মেকআপ করতে অত কৌতূহল নেই), অথবা কোন বিশেষ কোনো ব্যক্তির উক্তি— সব সে তার ডায়েরিতে লিখে রাখে। তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে তার ডায়রি। সে তার বেস্টফ্রেন্ডের নামও রেখেছে "স্বপ্নপরি"।
ডায়রি লেখা শেষ করেই মাকে খাবার দিতে বলে। যথারীতি তার কথা শেষ হতে না হতেই মা তার পছন্দের লুচি আর আলুর দম নিয়ে এসে হাজির।
― তুমি কী করে জানলে মা যে আজ আমার লুচি খেতে ইচ্ছা করছে?
― মেয়ের মনের কথা মা জানবে না তো কী পাড়াপড়শি জানতে আসবে?
― তুমি সত্যি খুব ভালো মা।
― হয়েছে হয়েছে। খাবার সময় অত কথা বলিস না। আগে খেয়ে নে।
― (খাওয়া শেষ করে) কী হলো মা, কিছু বলবে?
― হ্যাঁ, আসলে ঘটকমশায় এসেছিলেন। একটা খুব ভালো সম্বন্ধ এসেছে।
― মা আমি এখন বিয়ে করবো না।
― কেন? বয়স তো হলো তেইশ। আমাদেরও তো দায়িত্ব আছে।
― তাই বলে বিয়ে দিয়ে দেবে? আমি তো আগে একটা চাকরি করতে চাই।
― সে না হয় করবি। ওনারা আসতে চাইছেন, না করব কী করে? আর দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। লাখ কথায় বিয়ে হয়। আর তোর ইচ্ছার কথাটাও ওনাদের জানাস। যদি ওনারা আপত্তি না করে তাহলে ভালো আর আপত্তি করলে আমি ওরকম বাড়িতে আমার মেয়েকে পাঠাবো না।
― কিন্তু মা আমি তো ভালো রান্না করতে পারি না। যদি জিজ্ঞাসা করে কোন রান্নায় কী মশলা দিতে হয় আমি তো কিছুই বলতে পারবো না। ওনারা তখন তো আমার সাথে তোমাদেরকেও অপমান করবে যে মেয়েকে কিছুই শেখায়নি।
― দূর পাগলী মেয়ে সেই ভয়ে কি পাত্রপক্ষের কাছে বসবি না? আর ওনারা এক সপ্তাহ পর আসবেন। ততদিনে তোকে টুকিটাকি সব শিখিয়ে দেব। আর আমার মেয়ে রান্না না জানলেও বাকি যা গুণ আছে তাতে ঠিক পছন্দ করবে।
মা চলে যাওয়ার পর অপর্ণার হঠাৎ করে আজ ডায়রিতে লেখা কথাগুলো মনে পড়লো। তাহলে কি সত্যি ওর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো নতুন গল্পের সাথে?
নির্ধারিত দিনেই পাত্রপক্ষ অপর্ণাদের বাড়িতে উপস্থিত। পাত্রপক্ষ বলতে পাত্র নিজে, তার মা আর বাবা। আর কেউ আসেনি। পাত্রপক্ষ আসার আগেই অপর্ণা শাড়ি পরে সেজে রেডি। যদিও সে এই ক'দিনে রান্নার টুকিটাকি জিনিসগুলো মায়ের কাছ থেকে রপ্ত করে নিয়েছে। তাও তার মনের মধ্যে ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না। যদি তারা এমন কিছু প্রশ্ন করেন যেটার উত্তর সে দিতে না পারে। আবার কিছুক্ষণ পরেই তার মনে হয় যে যদি উত্তর দিতে না পারে তো কি হবে? এটা কি কোনো বোর্ড এক্সাম যে সব প্রশ্নের উত্তর জানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু উত্তর জানা না থাকলেও পাত্রপক্ষের কাছে নিজের মূল্য কমাতে নারাজ সে। মনের মধ্যে এরকম নানা প্রশ্নোত্তরের টানাপোড়েনে সে নিজেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সেই সময়েই পাশের ঘর থেকে শুনতে পেল পাত্রের মাকে বলতে-"কই এবার মেয়েকে নিয়ে আসুন।"
অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের ট্রেটা হাতে নিয়ে মায়ের সাথে বসার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। বড়দের প্রণাম সেরে পাত্রকে নমস্কার করে সবাইকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বসলো। বসার পরেই তার নাম, কতদূর পড়াশোনা করেছে, কোথায় পড়াশোনা করেছে এসব টুকটাক প্রশ্নগুলো পাত্রের মা সেরে তার ছেলেকে ইঙ্গিত করে বললো ''এবার তোর কী জানার আছে জিজ্ঞাসা কর।"
এতক্ষণ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অপর্ণার মনে একটু সাহস জন্মেছে। কিন্তু পাত্র আলাদা ভাবে কিছু জিজ্ঞাসা করবে শুনেই আবার তার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এত কিছুর মাঝে তো সে ভুলেই গেছে যে সে চাকরি করতে চায় সেটা পাত্রপক্ষকে জানাতে হবে।
― আমার নাম জানেন কিনা জানি না, তাও আর একবার বলছি। আমার নাম প্রতুল ঘোষাল। আমি বিজনেসম্যান। আমার নিজস্ব একটা কোম্পানি আছে। আমার একটাই প্রশ্ন তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?
যে প্রশ্নটা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি অপর্ণা, পাত্রপক্ষের কাছ থেকে সেটাই তাকে করা হচ্ছে। এটা স্বপ্ন না বাস্তব? আর এটার উত্তরটাই বা কী দেবে ভেবে উঠতে পারছে না। মা পাশ থেকে একটু কনুই দিয়ে ধাক্কা দিতেই মনে হলো এটা বাস্তব, স্বপ্ন নয়।
কিছুটা আমতা আমতা করে বলতে শুরু করলো, "আসলে আমি চাকরি করতে চাই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এমন একটা জায়গায় যেতে চাই যেখানে সবাই যেন আমাকে এক নামে চিনতে পারে। পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই। মানুষের সাথে মিশতে চাই, তাদের নানান রকম মানসিক দিক বুঝতে চাই।
কথাগুলো বলে একটু দম নিলো অপর্ণা।
― কী চাকরি করতে চাও?
― সেটা এখনো ঠিক করিনি। সবে মাত্র পড়াশোনা শেষ করলাম।
― তোমার স্বপ্ন যদি আমি পূরণ করতে সাহায্য করি তাহলে তুমি কি আমার সঙ্গ দেবে?
কথাটা শুনতেই অপর্ণার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। পরমুহূর্তেই কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে ওকে রাঙিয়ে দিল। মাথা নিচু করে নিল অপর্ণা। ওর এই মৌনতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে দুই বাড়ি থেকে অপর্ণা আর প্রতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল পরের মাসেই।
একদিন বিকালে অপর্ণা আবার ডায়েরি খুলে পেনটা দাঁতের মাঝে নিয়ে ভাবতে থাকে, এইভাবে তাড়াহুড়ো করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হলো?ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু খোঁজ খবর নিলে হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা কেমন বা তাকে হঠাৎ কেন এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল? সে তো অত সুন্দরী নয় যে তাকে এক দেখাতেই সবাই ওর প্রেমে পড়ে যাবে। তাহলে কি ওর চাকরি করতে চাওয়ার ইচ্ছার জন্য ওকে ভালো লেগেছে? ওর আর কী কী পছন্দ অপছন্দ কিছুই তো জিজ্ঞাসা করলো না। হাজারটা প্রশ্ন মনের মাঝে একসাথে ভিড় করে আসছে। শুধু উত্তরগুলো যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা লিখতে শুরু করলো―
"মনের কথা জানলি বল তুই কেমনে,
খোঁজ কি নিস দুইবেলা আমার স্বপনে?
রাখিস যদি তারা করে তোর নয়নে
আঁকবো তোকে কাজল দিয়ে খুব যতনে।"
অপর্ণার যদিও ইচ্ছা একটা চাকরি করবে ,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে কিন্তু আর পাঁচটা মেয়ের মতো ওর স্বপ্ন একটা ছোট সুখী সংসার হবে। অপর্ণার বাবা গ্রামের একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করতেন। তাই অল্প কিছু জমানো টাকা দিয়েই যতটা সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। যদিও প্রতুলদের বাড়ির স্টেটাসের সাথে তাদের কোনো তুলনাই হয় না।
বিয়ের দিন যথারীতি সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই এসে হাজির। বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়ির পরিবেশ একটু অন্য রকম হয়েছে। চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজানো। সানাইয়ের সুরের সাথে আনন্দের বন্যা বইছে শুধু। অপর্ণা মনে মনে ঠিক যেমন ভেবেছিল সব সেরকমই চলছে।
যথাসময়ে অপর্ণাদের বাড়ির সামনে বিশাল একটা গাড়িতে করে বর এসে উপস্থিত। বর দেখে আসার পর কিছু আত্মীয় স্বজন নিজেদের মধ্যেই বলাবলি শুরু করলো, "বর যেমন দেখতে তেমনি বড়লোক। অপর্ণার কপাল আছে বলতে হবে।"
অপর্ণার বাবার সারাক্ষণ এই চিন্তাতেই কাটলো যে, অত বড়লোক বাড়ির লোকজন সব, তার এই যৎসামান্য আয়োজনে কি তারা খুশি হবে? তবে শেষপর্যন্ত সব নিয়ম কানুন মেনেই সুষ্ঠ ভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো। কনকাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে নতুন জীবনে শ্বশুরবাড়ির দিকে গমন করলো অপর্ণা। চোখে সব কিছু ছেড়ে আসার জলের সাথে হাজার স্বপ্ন নিয়ে হাজির হলো শ্বশুরবাড়িতে। তাদেরকে অভ্যর্থনার আয়োজন দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। সব কিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছিলো যদিও এই স্বপ্নটা সে আগে কখনো দেখেনি। আচার অনুষ্ঠানের পর্ব সেরে নিজের ঘরে এসে তো আরো চমকে যায়। ঘরটার চারটি দেয়াল চার রকম। চারিদিকে রঙের খেলা। প্রয়োজনীয় প্রতিটা জিনিস খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। অপর্ণা ভেবেছিল সে তার নতুন সংসার নিজের হাতে সাজাবে কিন্তু এখানে তো আগে থেকেই সব পরিপাটি করে সাজানো। এসব দেখতে দেখতে সে এতটাই মোহিত হয়ে গেছে যে প্রতুল কখন ঘরে এসেছে সে খেয়ালই করেনি।
― তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
― না না।
― তোমার কিছু দরকার হলে শুধু একবার বলবে সব হাজির হয়ে যাবে।
― আচ্ছা বলবো।
― ঠিক আছে। কাল থেকে অনেক আচার অনুষ্ঠান পূরণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই। একটু বিশ্রাম করে নাও। কাল রাতে আবার বৌভাতের অনুষ্ঠান আছে।
― ঠিক আছে।
প্রতুল চলে যেতে একটু আরাম করে বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো, প্রতুলকে বাইরে থেকে বোঝাই যায়না যে মানুষটা এতটা কেয়ারিং।
স্বপ্নের মতো কিভাবে যে একমাস কেটে গেল অপর্ণা বুঝতেই পারলোনা। ইতিমধ্যে তাদের সুইজারল্যান্ডে মধুচন্দ্রিমা সম্পন্ন হয়ে গেছে। তার জীবনে যেন এক নতুন ছন্দ সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার সব থেকে যে কাজে ভয় ছিল সেটা তাকে করতেই হয়নি, সেটা হলো রান্না। বাড়িতে তো প্রতিটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা কাজের লোক রয়েছে। তার যখন যেটা খেতে ইচ্ছা করতো শুধু মুখ ফুটে বললেই হাজির হয়ে যেত। এত ভালো একটা শ্বশুরবাড়ি এবং এত ভালো মানুষজন তার ভাগ্যে ছিল সেটা তার স্বপ্নেরও বাইরে। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, প্রতুল সবাই তাকে খুব ভালোবাসে, খুব যত্ন করে।
একদিন রাতে খাবার পর প্রতুল অপর্ণার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল
― তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
― অসুবিধা কিসের?আমার তো খুব ভালো লাগছে।
― ভালো তবে। তো তোমাকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম তুমি তোমার স্বপ্নের কথা আমাকে জানিয়েছিলে মনে আছে?
― হ্যাঁ মনে আছে।
― তুমি কি এখনো সেই স্বপ্ন টা পূরণ করতে চাও?
― হ্যাঁ চাই। এমনিতে বাড়িতে তো সারাদিন বসে থাকি। কোনো কাজ করতেই হয় না। তুমিও বাড়িতে বেশি থাকোনা। যদি একটা চাকরি করতাম সময়টা কেটে যেত।
― ঠিক আছে। তার আগে তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। তারপর বলবো তোমার চাকরিটা কী।
― আচ্ছা কী শিখতে হবে?
― সব জানতে পারবে আস্তে আস্তে। কাল থেকে মিঃ বোস আসবেন, তিনি তোমাকে ট্রেনিং দেবেন। তুমি শুধু তার সাথে একটু সহযোগিতা করবে।
― অবশ্যই করবো।
― সব কিছুর আগে একটাই কথা বলে রাখি। সাফল্য কিন্তু এমনি এমনি আসেনা, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মনে রেখো।
কথাগুলো অত না বুঝেই অপর্ণা বলল, "আমি পারবো। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।"
কথাটা বলেই অপর্না প্রতুল এর কাঁধে মাথাটা রাখলো। প্রতুলও অপর্ণাকে নিজের বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
ঠিক তার পরের দিন থেকেই শুরু হলো অপর্ণার স্বপ্নপূরণের প্রস্তুতিপর্ব।
অপর্ণা দিনের শুরুতেই ডায়েরি খুলে লিখতে বসে- "স্বপ্ন আমার হাতছানি দেয়, সোনার কাঠি স্পর্শ করে;
স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, রাখিস আমায় যত্ন করে।"
অস্মি সেনগুপ্ত ©
0 Comments