প্রকৃতি, পরিবেশ, আমি, আপনি
মৃণাল কান্তি দেব
কবি, সাহিত্যিক,দার্শনিক থেকে আরম্ভ করে বহু বিজ্ঞানী একথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা আছে, নিজস্ব সুর আছে, নিজস্ব ছন্দ আছে। আর প্রকৃতিই তো পরিবেশের মূল ভিত্তি। রোমান্টিক যুগের কবি, গবেষকদের লেখায় প্রকৃতিই নায়িকা রুপে অধিষ্ঠাত্রী। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চিন্তাভাবনার বিস্তার এই স্তর পর্যন্ত পৌঁছতো তাহলে হয়তো পরিবেশ আজকের এই সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতো না। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের সূক্ষ ভাবনার শিকড়গুলোর দ্রুত বিনষ্ট হওয়ার কারণেই আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ তার সত্ত্বা হারাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবেশ বিষয়কে রাখলেই কিংবা অহরহ আন্তর্জাতিক কনফারেন্স এর আয়োজন করলেই পরিবেশের সংস্কার হয় না, কারন কৃত্রিমভাবে কখনোই মানুষ ও প্রকৃতির সংযোগ স্থাপন করা যায় না।
পরিবেশের নানা রঙ আছে। প্রকৃতির গর্ভগৃহ থেকে সৃষ্টি হওয়া রঙীন সতেজ পরিবেশের প্রতিটি উপাদান পারস্পরিকভাবে যুক্ত থাকে। কিন্তু স্বাভাবিক রঙে, স্বাভাবিক ছন্দে প্রযুক্তির মোহ এসে মিশলে বৃহত্তর পরিবেশের রাগ রাগিনী হারিয়ে যায়। ভোরবেলা শিশিরভেজা ঘাসে আপনি আমি দাঁড়িয়ে। ফুরফুরে সতেজ হাওয়া, আর আমরা পরস্পর বিনিময় করছি আমাদের মনের কথা। শীতল বাতাস আপনার মনের কক্ষকে সতেজ করছে আর আপনি প্রকাশ করছেন আপনার কথা। ধরুন, আপনার হৃদয়ের চোরাগলিতে থাকা ভাষারা সঠিকভাবে পরিস্ফুটিত হতে পারছে না। আপনি ক্রোধাগ্নিকে ক্রমশ জাগিয়ে তুলছেন। হঠাৎই আপনি চলে এলেন দিনের আলোয়। প্রচন্ড রোদ, আপনি এসে বসলেন ছায়ায়। তাপ আর শীতল ছায়ার এই সংমিশ্রণ আপনাকে নিয়ে এলো বৃহত্তর পরিবেশের প্রথম শামিয়ানায়। গাছে গাছে ঘুরছে চড়ুই, ফিঙে, কোকিল, বেনেবউ আর আপনিও ওদের ছন্দ দেখতে দেখতে পুনর্গঠন করলেন আপনার সৃষ্টির প্রাসাদকে। অ্যানজিওপ্লাষ্টিতে না হয় হার্ট টাকে বাঁচানো গেলো, কিন্তু মনের রাজপথে ব্লকেজ ধরা পড়লে? পরিবেশ ভরসা। প্রকৃতিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া পরিবেশই ভরসা। কিন্তু এই ভরসার জায়গাটাই যদি বিষাক্ত হয়ে যায়?আচ্ছা ধরুন,প্রেম যদি স্নিগ্ধতা না এনে দমবন্ধ করা এক জটিল অবস্থা তৈরী করে তখন? এই বিষয়টাও ঠিক সেরকম। আপনি প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে মোহ আর প্রযুক্তির জটিল তরঙ্গের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। প্রকৃতি কতদিন সইবে এই দাসত্ব? আজকের এই অসহনীয় পরিবেশ প্রকৃতির করা প্রত্যাঘাত তো বটেই!
গুটিকয়েক মানুষ এই সময়েও প্রকৃতির সাথে সংযোগ ঘটাচ্ছেন। কিন্তু গুটিকয়েক মানুষ নয়, আমাদের সমাজের একাংশকে এগিয়ে আসতে হবে। এই প্রসঙ্গে আট হাজার বৃক্ষের মা সালুমারাদা থিম্মাক্কা'র কথা তো উল্লেখ করতেই হয়। বিশ্বকবি বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন। তাই সমাজ, পরিবেশ ও প্রকৃতির মধ্যে থাকা শিরা ধমনীকে চিনতে পেরেছিলেন। ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ডের অনেক সমাজতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানী প্রকৃতি ও পরিবেশকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়েছেন। মনেরও একটা ইমিউনিটি সিস্টেম আছে। আবার পরিবেশেরও আছে। একে অপরকে রক্ষা করে। যদি পুরো বাস্তুতন্ত্রকে নিয়ে বলতে হয়, তাহলে বলবো বাস্তুতন্ত্রই প্রকৃত অর্থে ম্যাজিক্যাল স্ফীয়ার। সংযোগবাদ ও নির্মিতিবাদ এর একক কিন্তু এই পরিবেশ। মডার্ন রিসার্চ দেখিয়েছে যে শিশু যত বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড়ো হয়,সে ততো বেশি করে বুঝতে শেখে বৃহত্তর পরিবেশকে। বহুক্ষেত্রে জীবনদায়ী ঔষধের মতো কাজ করা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশের ঘ্রান, রস, ছন্দ, বর্ণ থেকেই সৃষ্ট। কিছুদিন আগেই একটা লেখা পড়ছিলাম যেখানে একজন হার্ট স্পেশালিস্ট বলছেন হালকা হাওয়া, নদীর পাড়, সন্ধ্যারতি এগুলোই তাঁর বন্ধু, ঔষধ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বরাবরই শিরোনামে থাকে। কিন্তু মনের চোখ দিয়ে পরিবেশকে দেখলে কবেই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর এই বাড়বড়ন্ত বন্ধ হয়ে যেত। সমস্যাটা এখানেই। আমরা বাজার গরম করি, পরিবেশ দূষিত করি আর মাঝে মধ্যে সেমিনারে যাই। প্রকৃতি ও পরিবেশ বর্তমানে একটা শ্রেণীর মানুষের কাছে কেবল পণ্য কিংবা ওপরে উঠবার সিঁড়ি। কিন্তু প্রাণবায়ু যদি হঠাৎই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে তাহলে মোহের পর্দা আর মায়ার চাদর নিমেষেই খসে যাবে।
একটি বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিয়ালের সংলাপে থাকা একটা লাইন খুব বলতে ইচ্ছে করছে। 'তুমি nature ভালোবাসো, তুমি butterfly ভালোবাসো, তুমি sky ভালোবাসো, প্রিয় মানুষের মৃত্যুর পরেও তুমি পৃথিবীকে ভালোবাসতে পারো, তুমি কখনোই অপরাধী নও। আর তুমি তো নিজেই sweet butterfly…তুমি নতুন করে জীবন শুরু করো। ' যে প্রকৃতিকন্যার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা হয়েছিল সে তৎক্ষণাৎ তার প্রতিশোধের আগুনকে পরিণত করলো সমাজ গঠনকারী মানবিক আগুনে। প্রকৃতিকে ভালোবাসুন। পরিবেশের বিষাক্ত রাজপথে স্বাভাবিক ছন্দকে জাগিয়ে তুলুন। তবেই জীবনের প্রকৃত স্রোত উপলব্ধি করবেন আলোছায়ার বন্দরেতে।
0 Comments