"কিগো শুনছো..!! কত বেলা হয়ে গেল তো। এবার ওঠো।"
আমি পাশ ফিরে চাদরটা মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মাথায় এলো আজকে অফিসে বস কে রিপোর্টটা জমা দিতে হবে। কাজটা কালকে বস আমাকে দিয়েছিলো। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। ঘড়িতে তখন ৮:১৫ বাজে। অর্পিকে ডেকে বললাম, "জলটা গরম করে দাও তো তাড়াতাড়ি"।
অর্পিতা, আমার বউ। ভালোবেসে অর্পি বলে ডাকি।
স্নান সেরে এসে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। ওদিকে অর্পি ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজাচ্ছে। অফিসের কাগজ-পত্রগুলো আমার টেবিলেই রয়ে গেছে। রাতে কাজ করতে করতে আর গুছিয়ে রাখা হয়নি।
"উফফফ...!! পেপারগুলো যে আটকাবো, একটা পেপার ক্লিপও পাচ্ছিনা।" টেবিলে, ড্রয়ারে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলাম। এদিকে ৯টা বেজে গেছে। ৯:২৫ এর বাসটা ধরতেই হবে। শেষমেষ একটা পেপার পিন খুঁজে পেলাম। কাগজগুলোকে আটকে ফাইলে ভরে নিলাম। ড্রয়ারটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়লো ড্রয়ারের ভেতরে শেষ প্রান্তে.. একটি গোলাপি রঙের কাগজ। অনেকদিন পড়ে থেকে কেমন যেন ধূসর হয়ে এসেছে। কাগজটি হাতে নিয়ে খুলতেই ...
"তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই,
কিন্তু তুমি আমার হৃদয়ে চিরদিনের মতো বাসা করে নিয়েছো।
অনেক কিছু না বলা রয়ে গেল। ভালো থেকো ....সুখে থেকো ...।
--- তোমার কাছের বন্ধু
অনিতা "
পড়তে পড়তে পৌঁছে গেলাম ৭ বছর আগের কলেজ লাইফে। কলেজের প্রথম দিন ...,অটো থেকে নেমে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে কলেজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম| তারপর গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, "দাদা ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসটা কোথায় বলতে পারবে?"
---কোন রুমে বলতে পারছিনা তবে দোতলাতে হয়।"
---আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ।"
আমি দোতালার দিকে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেলাম..
---"এই যে কি হচ্ছে এসব?"
ঘুরে দেখি একটি মেয়ে। আমি কিছু বলার আগেই আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি হলো। কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম যখন মেয়েটি বললো,
---"আমি তোমাকে চিনিনা জানিনা; তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে চিঠি দেওয়ার? এরপর যদি এরকম করেছো তো সোজা জেলের হাওয়া খাইয়ে দেব।"
এই বলে সে সেখান থেকে চলে গেলো। আমি কিছু বলার সুযোগ ও পেলাম না।
যাই হোক, কোনো রকমে ক্লাসরুমটা খুঁজে পেলাম। রুমে ঢুকতেই দেখি সেই মেয়েটি বাঁদিকের দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে পাশের বান্ধবীর সাথে কথা বলছে। তখন আমাকে লক্ষ্য করেনি, আমিও আর কিছু বলতে যাইনি। চুপচাপ ডানদিকের তৃতীয় বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ করে ওর নজর পড়লো আমার দিকে। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আবার আমাকে মারতে চাইছে। ক্লাস শেষে আমি নিজের মত বেরিয়ে গেলাম।
পরের দিন আমি আবার ডান দিকের তৃতীয় বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ দেখি মেয়েটি আমার পাশে এসে বসলো।
---"সরি !!! আসলে আমি অন্য একজনকে ভেবে তোমাকে চড় মেরে ফেলেছি..,I am very sorry। কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বললে না কেন কালকে?"
---"আমার প্রথম দিন ছিল কালকে। আর যখন চড় মারলে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম দুটো কথা শোনাবো। তারপর ভাবলাম, প্রথমদিন ঝামেলা করা ঠিক হবেনা। তাই আর ...."
এরপর আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলা শুরু হয়ে গেলো। আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। বুঝতেই পারিনি যে কখন ও আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে।
আমরা একটা ফিল্ম দেখার প্ল্যান করেছি। মনে মনে বেশ এক্সাইটেড ছিলামি। রোজকার মতো ডানদিকের তৃতীয় বেঞ্চে বসে ওর অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু সেদিন ও এলো না।ক্লাসে বসে শুধু ওর কথাই ভাবছিলাম। ক্লাস শেষে ওকে অনেকবার কল করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারলাম না।
টানা দুদিন ওর কোনো খোঁজ পেলাম না। এরপর একদিন ক্লাসে বসে ওর কথা ভাবতে ভাবতে বুঝতেই পারিনি কখন ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সকলেই চলে গেছে। বুঝতে পারছিলাম না কি হল। হঠাৎ ওর এক বান্ধবী আমার কাছে এসে বললো.., "এই চিঠিটা তোমার জন্য.. অনিতা দিয়েছে।"
আর কিছু না ভেবেই আমি কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলাম--
"তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই ..... ... ..।"
চোখের জল আর আটকে রাখতে পারিনি। হঠাৎ ডাক পড়লো..
---"কি গো, ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে গেছে তো। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে..।" কোনোরকমে চোখের জল মুছে ঘড়ির দিকে তাকালাম.... ৯:১০ বাজে। চিঠিটা আবার ড্রয়ারে রেখে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ছুট লাগালাম।
সত্যি .... অনেক কিছু না বলা রয়ে গেল!!
© মনোজ রায়
0 Comments