কৃষ্ণনগরে দূর্গাপূজা কার্যত গ্রুপ লিগ খেলার মত; কালী পূজা সেমিফাইনাল আর জগদ্ধাত্রী পূজা ফাইনাল। কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। আর সেই শুরুর ইতিহাস আজও মানুষের মুখে মুখে পূজার সময় ফিরে আসে।
বকেয়া রাজস্বের দায়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করেন সেই সময়ের নবাব আলিবর্দি খাঁ। এরপর কিছুদিনের মধ্যে নদীয়া থেকে রাজস্ব পাঠিয়ে দিলে আলিবর্দি খাঁ তাঁকে মুক্ত করেন। রাজা নৌকা করে কৃষ্ণনগরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। নৌকায় ঢাকের আওয়াজ শুনে রাজা বুঝতে পারেন, আজ বিজয়া দশমী। এরপর তিনি দুঃখ ভরা মন নিয়ে বিশ্রাম করছিলেন| হঠাত্ স্বপ্নে তিনি দেখতে পান, এক ঘোড়াদাবা সিংহের উপর একদেবী রয়েছেন। তাঁর হাতে শঙ্খচক্র, তিনি ধনুর্ধারিনী। হঠাৎ একটি ধাতব শব্দে রাজার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি পরেরদিন কৃষ্ণনগর পৌছে রাজদরবারে সকলকে জানান তাঁর স্বপ্নের কথা। রাজপন্ডিত সবশুনে তাঁকে বলেন-"উনি দেবী জগদ্ধাত্রী; কার্ত্তিক মাসের তিথিতে পূজিতা হন।" তবে অনেকে আলিবর্দির পরিবর্তে নবাব মীরকাশিম ও নবমী তিথির কথা বলেন|
অন্য একটি কিংবিদন্তিও জানা যায়--কৃষ্ণনগরে আসার জন্য রাজা আঠারোটি দাঁড়ের পানসি নৌকায় করে রওনা হন| প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তিনি দশমীর রাতেও পৌঁছাতে পারেন নি| দশমীর রাতে তিনি দেখেন রাজ রাজেশ্বরীকে (রাজবাড়ির দূর্গা প্রতিমার নাম)। তিনি রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন বাড়ি গিয়ে তপস্যায় বসতে। দ্বিতীয়দিনে বহু বাধাবিঘ্নের সৃষ্টি হলেও তিনি যেন পিছন ফিরে না তাকান; তবেই তিনি বাক্ সিদ্ধ হবেন এবং সামনে যে দেবীর মুখ দেখবেন তাঁকেই পূজা করবেন | তারপর কৃষ্ণচন্দ্র তপস্যায় বসলেন। প্ৰথমদিন ভালোভাবে কেটে গেল। দ্বিতীয়দিনে তিনি ভূতপ্রেতের বিকট চিৎকারে ভয় পেয়ে পিছনে তাকাতেই দেখলেন জগদ্ধাত্রী| তখন থেকেই পূজা শুরু হয়।
শুরু থেকেই কৃষ্ণনগরের পূজা ছিল একদিনের; কার্ত্তিক মাসের শুক্লা নবমীর দিন। দশমীতে বিশাল শোভাযাত্রা সহযোগে বিসৰ্জন হত | শোভাযাত্রার শুরুতে থাকত রাজকীয় বেশে একটি হাতী। সঙ্গে থাকতো ঘোড়া, ঢাক, ঢোল, সানাই। কৃষ্ণনগরের রাজপথে সপারিষদ রাজা যেতেন। বর্তমানে রাজ-রাজত্ব নেই, তবুও এখনও কৃষ্ণনগরের মানুষ পূজার সময় একবার রাজবাড়ির পূজা দেখতে যাবেই যাবে। এখন আর রাজপথে রাজবাড়ির প্ৰতিমা আসে না, রাজবাড়ির দিঘিতেই বিসৰ্জন দেওয়া হয়। প্ৰচলিত আছে এটি একটি নদী যার নাম অঞ্জনা। তবে এখন বয়স্ক মানুষরা অঞ্জনা খাল বলেন|
কৃষ্ণনগরে পূজা শুরুর পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন জায়গায় পূজা ছড়িয়ে দেন। মূলত রাজার অনুদানেই পূজা হত। এখন শুধুমাত্র একটি বারোয়ারী পূজার জন্য সাম্মানিক অনুদান পায়। বেশকিছু বারোয়ারী ও ক্লাবে প্ৰতিমার একটি করে নামও থাকে, যেমন- বড়মা, মেজ মা,ছোট মা, ভালো মা, সোনা মা, মিষ্টিমা, অন্নপূর্না, মণি মা,চারদিনী মা, বুড়িমা, জলেশ্বরী ইত্যাদি।
পূর্বে শুধুই পূজা, প্ৰতিমা ও প্ৰতিমা বিসৰ্জনই আকষর্নের কেন্দ্র ছিল। রাজবাড়ীর প্ৰতিমা নিরঞ্জনের পর এক এক করে সব প্ৰতিমা রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত। রাজবাড়ী থেকে উপহার হিসাবে পিতলের ঘড়া দেওয়া হত। ঘড়াটিকে বাঁশের মাথায় লাগিয়ে প্ৰতিমা আড়ং বা সাং-এর মাধ্যমে কদমতলা ঘাটে বিসৰ্জন দেওয়া হত। রাজবাড়ী থেকে এখন আর কোন উপহার দেওয়া না হলেও, প্ৰতিটি প্ৰতিমাকে এখনো রাজবাড়ী ঘুরিয়ে রাজপথ দিয়ে নিয়ে আসা হয়। রাজপথের কোন এক জায়গায় অপেক্ষা করলে সব প্ৰতিমা দেখা যায়। বর্তমানে দুইদিন ধরে প্ৰতিমা বিসৰ্জন হয়। দশমী, অর্থাৎ বিসৰ্জনের প্ৰথমদিন সকালে ঘট বিসৰ্জন শোভাযাত্রার আয়োজন হয়। কিছু বারোয়ারী এতে অংশ নেয়। বিভিন্ন ট্যাবলো সহযোগে এই শোভাযাত্রা হয়। রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী থেকে এ.পি.জে. আব্দুল কালাম, শাহরুখ খান থেকে দেব, বিভিন্ন সরকারী প্ৰকল্প, সচেতনা,পূজার ইতিহাস উঠে আসে ট্যাবলো তে, যা দেখতে রাজপথে রোদ্দুরে অপেক্ষা করে বহু মানুষ ভিড় করেন। সাথে বহুরকমের বাজনা, মুখে "উই উই", "আসছে কারা???"" বলে পাড়ার নাম ধরে সমবেত আওয়াজ, কখনও তাদের প্ৰতিমার নাম করে জয় জয় ধ্বনি, মাঝে মাঝে হাততালির সমবেত আওয়াজ, প্ৰতিমা নিরঞ্জনে সময় আড়ং বা সাঙ মানে কাঁধে করে প্ৰতিমা নিয়ে ঢাকের তালে লাফালাফি করে দৌড়ে আসা-- এটাই আনন্দ।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বারোয়ারী :
চাষাপাড়া-- প্ৰথম বারোয়ারী হিসাবে প্রথম বছর ঘটপূজা শুরু করে। দ্বিতীয় বছর পটচিত্রে এবং তারপরের বছর থেকে প্ৰতিমার মাধ্যমে পূজা হয়, যা সারাদেশে জনপ্ৰিয় "বুড়িমা" নামে। এবছর ২৪৪তম বর্ষ। দেবীকে এখানে স্বর্নালঙ্কারে সাজানো হয়।
মালোপাড়া-- এখানকার মা 'শ্ৰী শ্ৰী জলেশ্বরী দেবী' নামে বিখ্যাত| ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে এই বারোয়ারী রয়েছে। এই বারোয়ারী কৃষ্ণনগরের একমাত্র বারোয়ারী যারা এখনও রাজ পরিবার থেকে অনুদান পায়। পূজার আগেরদিন রাতে ছেলেরা মেয়ে সেজে জল আনতে যায় জলঙ্গী নদীতে। এই প্ৰথার নাম জলসজ্জা। এছাড়া ঐতিহ্যের মধ্যে আছে ধুনো পোড়ানো, বলি প্ৰথা। এখনো এখানে কার্বাইট গ্যাসের আলো বিসৰ্জনের সময় মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে, যা দেখতে সবাই একবছর অপেক্ষা করে থাকে।
বাঘাডাঙ্গা-- কৃষ্ণনগরের অন্যতম পুরনো পূজা। নতুন থিম, বাঘ-সিংহের লড়াই-এ দেবীর অবস্থান।
কাঠালপোতা বারোয়ারী-- মূলত প্ৰতিমা নির্ভর পূজা।
রাধানগর অন্নপূর্না সরণী-- থিমের জোয়ার। এবারের আকর্ষণ কর্ণাটকের মাদুরেশ্বর শিব মন্দির।
শক্তিনগর এম.এন.বি-- বড় বাজেটের থিমনির্ভর পূজা।
এছাড়া থিমের কাজ দেখা যায়- ঘূর্ণি ভাই ভাই, ঘূর্ণি শিবতলা, ঘূর্ণি হালদার পাড়া, তাঁতিপাড়া, দর্জিপাড়া, শক্তিনগর পাঁচ মাথা মোড়, আমিন বাজার, বাগদি পাড়া প্ৰভৃতি স্থানে।
মাদল--কৃষ্ণনগরে "মাদল" জনপ্ৰিয়তা লাভ করেছে। শিল্পী সায়ন তরফদারের হাত ধরে নতুন ভাবনাকে সাথে নিয়ে তারা এবার সাত বছরে। অভিনব প্ৰতিমা ও বিষয়ভাবনাকে নিয়ে শহরে আলদা জায়গা করে নিয়েছে।ষসাধারণত প্ৰতিমা প্ৰতিটা বারোয়ারী একই রাখে, কিন্তু মাদল প্ৰতিবছর নতুন নতুন ভাবনায় তাদের প্ৰতিমা ও মণ্ডপসজ্জা করছে, যা শহর বাসীর কাছে নতুন পাওয়া।
রাজদূতক্লাব, ক্লাব বিশ্বরূপা, চকের পাড়া--সুসজ্জিত প্ৰতিমা
নুড়িপাড়া বারোয়ারী -- কৃষ্ণনগরের একমাত্র পূজা যা চারদিন ধরে হয়। তাই এখানকার প্ৰতিমা চারদিনী মা নামে খ্যাত।
কালিনগর ক্লাব রেনবো-- নতুন নতুন থিমের ভাবনায় নজরকাড়া, বড় বাজেটের পূজা।
পাত্রবাজার স্বীকৃতি -- থিমেই বাজিমাত করে পাত্রবাজার।
হাতারপাড়া-- ঘট বিসৰ্জন মূল আর্কষণ।
এছাড়াও কয়েকটি বড়পূজা হল--যুবগোষ্ঠী, গোলাপট্টি, উকিলপাড়া, কাঠুরিয়া পাড়া, ষষ্ঠীতলা, নেদেরপাড়া, বৌবাজার, শক্তি সংঘ, চৌধুরী পাড়া, রায়পাড়া-মালি পাড়া, বালকেশ্বরী, জজকোর্ট পাড়া,কলেজষ্ট্রীট, নাজিরা পাড়া, ক্লাব একতা, সেন্ট্রাল ক্লাব, আমরা কজন, অনন্যা ইত্যাদি | বাড়ি, ক্লাব ও বারোয়ারী মিলিয়ে ছোটবড় প্ৰায় ৪৫০ টি মত পূজা হয়। সর্বশেষে বলতেই হবে কৃষ্ণনগরে পূজা আবেগের, ভালোবাসার ।
© গৌরব হালদার
0 Comments