Ad Code

.
.
1 / 8
2 / 8
3 / 8
4 / 8
5 / 8
6 / 8
7 / 8
8 / 8

"পাপ বিদায়" (দ্বিতীয় পর্ব) ~ হর্ষময় মণ্ডল

 

যারা ভবঘুরে বা নিকম্মার ঢেঁকি, তারা নির্লজ্জ ও বেহায়া প্রকৃতির হয়। অরিত্রও তাই। আমাকে দেখে একগাল তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, "ঐ তো সৌরিজা এসে গেছে। কেমন আছো? শরীর কেমন আছে? ঠিক আছে ঠিক আছে, সেসব পরে জিজ্ঞাসা করবো, এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে...." কোন কথাটা আগে বলে নিজের দ্বায়িত্বহীনতাকে চাপা দিতে পারবে সেই কথা খুঁজে বেড়াতে লাগল। আমি ঘৃণায় কোন কথা না বলে সোজা বেডরুমে ঢুকে পোশাক বদলে একটা নাইটি পরলাম। তারপর হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মাকে বললাম, "মা খেতে দাও। খাওয়া দাওয়া সেরে রেস্ট নেবো, বিকেলে শো আছে।"
এদিকে পেটের বাচ্চার বয়সও সাত মাস, তার
ও রেস্ট চাই, তাই শুয়ে পড়লাম। ওমা...!! অরিত্র গুটি গুটি পায়ে এসে সোজা বিছানায় বসলো।
আমার ঘুম লেগে এসেছিল তাই খুব রাগ হয়ে
গেল। তবু রাগকে দমন করে শান্ত স্বরে বললাম,
"তুমি অন্য ঘরে যাও মা নিশ্চয় ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমি ক্লান্ত, রেস্ট নিতে দাও।"
অরিত্র বলল, "নিশ্চয় নিশ্চয়, দু' চারটি কথা বলে চলে যাবো।
-- তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।
-- তা বললে হয়! ওটা তোমার রাগের কথা। তোমার পেটে যেটা দিন দিন বাড়ছে তার বাবা তো আমি। তাহলে কথা নেই বললেই হবে? আমার সন্তান কেমন আছে জানতে হবে না?
-- হ্যাঁ, তাই তো তাই তো। সত্যিই তো জানতে হবে। তবে শোন পেটের বাচ্চাকে ভালো রাখতে মাসে মাসে ডাক্তার দেখাতে হয়, ভিটামিন যুক্ত খাবার খেতে হয়। জানো তো এ সময়ে এটা ওটা নানান খাবার খেতে ইচ্ছে করে। তারপর ডেলিভারির সময় নার্সিংহোমের
খরচ। বুঝতেই পারছো টাকা ছাড়া কিছুই হবে
না। কত টাকা এনেছো দাও। তোমার সন্তানকে 
ভালো রাখতে দাও।
-- তুমি আমার সাথে মজা করছো।
-- মজা, মজা করবো কেন?
-- মজা নয়তো কি! তুমি জানো আমি কোন রোজগার করি না। আমি টাকা কোথায় পাবো?
-- তাহলে কী জন্য এসেছো? অসভ্য, ইতর,
ছোটলোক, বর্বর। আমি উঠে বসে চিৎকার করে বললাম।
-- আস্তে আস্তে! কী হচ্ছে কী? পাড়ার সকলে শুনতে পাবে যে। সেটা কি ভালো হবে?
আমি চুপ করে গেলাম। সত্যি তো পাড়ার লোককে শুনিয়ে কী লাভ।
আমাকে চুপ করতে দেখে বলল, "তোমার তো গানের খুব সুনাম। তোমার সুনামে আমার গর্বে বুক ভরে যায়। কিন্তু শুধু বুক ভরলেই তো হবে না, পেটও তো ভরতে হবে। তুমি এখন প্রচুর টাকা রোজগার করছো। এই অভাগা স্বামীর দিকে একটু সুনজরে তাকাও। আমার সম্পত্তিতে যেমন তোমার অধিকার তেমনি তোমার টাকাতেও তো আমার অধিকার আছে নাকি?
-- অধিকার! কিসের অধিকার? তুমি আমাকে গান বাজনা শিখিয়েছিলে যে তার জন্য রোজগারের টাকা তোমার হাতে তুলে দেবো? বেহায়া, লোভী, অসভ্য,অকর্মন্য , মদ-মাতাল... বেরিয়ে যাও। বেরিয়ে যাও এ ঘর থেকে।
-- যাচ্ছি যাচ্ছি। শোন না, আমাকে হাজার দশেক টাকা দাও। বাজারে প্রচুর ধার হয়ে গেছে। রাস্তায় বেরোতে পারছি না, পকেটে কানা কড়িও নেই।
এই কথায় আমার রক্ত চক্ষু দেখে বলল, "ঠিক
আছে ঠিক আছে.. হাজার পাঁচেক দাও, সাময়িক কাজ চালিয়ে নেবো।পরে না হয় আবার নিয়ে যাবো।
-- "বাবা.. বাবা...." আমি চিৎকার করে ডাকতে
লাগলাম।
বাবা দৌঁড়তে দৌঁড়তে এসে বলল, "কী হয়েছে মা?"
-- একে এক্ষুনি এখান থেকে নিয়ে যাও। আমার ঘুমের দরকার আছে, রাত্রে শো আছে।
-- অরিত্র চলো।
-- চলে তো যাবোই। জানেন বাবা আমার কাছে কোন টাকা নেই। বাজারেও প্রচুর দেনা। "আমার স্ত্রী বড় গায়িকা" এই বলে বাজারে ধার করেছি। তাই সৌরিজা যদি হাজার পাঁচেকও দেয় তাহলে রাস্তাঘাটে অন্তত মুখ দেখাতে পারি, দু-পাঁচশো করে দেনাদারদের দিয়ে।
-- কি নির্লজ্জ তুমি!! ছিঃ তোমাকে স্বামী ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে। পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করতে কত কষ্ট করতে হয় জানো?
-- জানি তো, মাত্র পাঁচটি শো।
-- হ্যাঁ পাঁচটি শো। যদি গান খারাপ হয় তাহলে পচা ডিম, পচা টমাটো, ছেঁড়া জুতো সব খেতে হবে, কেউ ক্ষমা করবে না। কেননা ওরা টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কষ্টার্জিত টাকার একটা টাকাও তোমার মতো অকর্মণ্যকে দেবো না। বাবা ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও।
বাবা জোর করে তুলে নিয়ে গেলো ওকে। পরে শুনলাম বাবা হাজার খানেক টাকা দিয়ে বিদায় করেছে।
***     ***      ***
             বিনা অর্থব্যয়ে সরকারি হাসপাতালে নর্মাল ডেলিভারি হলো। আমার ছেলে হলো। নাম রাখলাম সায়ন্তন। বাবা-মা আমাকে পাক্কা ছ'মাস গান গাইতে যেত দিলো না। সায়ন্তন হওয়ার মাস তিনেক পরেই আমি বলেছিলাম, "আমার কোন অসুবিধা নেই, আমি পারবো গান গাইতে। কিন্তু বাবা-মা আমার কথা শুনলো না।"
ছ'মাস পর আবার প্রাকটিসে গেলাম। আমি গান প্রাকটিস করে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম। এদিন শো ছিল না, তাই বিকেলে রিহার্সাল ছিল। বাড়িতে ঢুকেই দেখি বাবা-মা মুখ চুন করে বসে আছে, মায়ের কোলে সায়ন্তন। আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কী হয়েছে? এভাবে গালে হাত দিয়ে বসে আছো কেন বাবা?"
মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, "শ্রেষ্ঠা আয়ূষা সেই
যে স্কুলে গেছে আর বাড়ি ফেরেনি।"
-- সেকি! ভয় সূচক শব্দ আমার গলা থেকে বেরিয়ে এলো। আমি আগেই বলেছি আমার দুটো বোন, শ্রেষ্ঠা ও আয়ূষা। এরা যমজ। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, "দেখো হয়তো স্কুলের পথেই টিউশন গেছে, বা স্কুলে হয়তো কোন অনুষ্ঠান হবে তার রিহার্সাল হচ্ছে।"
বাবা বললো, "না, স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। টিউশনিও যায়নি। যেখানে যেখানে টিউশন যায় সেই সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কোথাও যায়নি।"
-- বন্ধুদের ঘরেও তো যেতে পারে!
বাবা বললো, "তা পারে, তবে না বলে তো যায়না।"
-- ঠিক আছে ধৈর্য ধরো, শান্ত হও, আমি দেখছি।
ততক্ষণে সায়ন্তন ঝাঁপিয়ে আমার কোলে। তাকে দুধ খাইয়ে শান্ত করে মায়ের কোলে দিয়ে বললাম, "ধরো একে, আমি দেখছি।"
বোনেদের রুমটি ভালো করে চেক করে দেখলাম, না কোন বাড়তি জামা কাপড় নিয়ে যায়নি বা লিখেও যায়নি কিছু। আমি বাইরে এসে বাবাকে জিজ্ঞেসা করলাম, "বাবা শ্রেষ্ঠা, আয়ূষা স্কুলে গেছিলো?"
-- কী করে জানবো? আমি যখন স্কুলে গেলাম
তখন স্কুল বন্ধ। তাছাড়া স্কুল ব্যাগ নিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।
-- ও..! তাহলে কী করা যায় বলো তো, আমি কি রাস্তায় একবার দেখে আসবো?
-- না, তুই মেয়ে হয়ে কোথায় খুঁজবি। তারপর
রাত হচ্ছে।
            কথা বলতে বলতে সৌরিজার ফোনে ফোন এলো একটা অচেনা নম্বর থেকে। আমরা তিন জনে ভয়ে আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। বাবা বললো, "ফোন টা রিসিভ কর।"
--- হ্যালো ------
--- দিদি আমি শ্রেষ্ঠা বলছি।
---  শ্রেষ্ঠা!  বাবা শ্রেষ্ঠা কথা বলছে। আয়ূষা কোথায়?
--- আয়ূষা আমার পাশে।
--- তোরা কোথায়?
--- আমরা দীঘায়।
আমি ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, "দীঘায় কী করছিস? আমরা এদিকে চিন্তায় মরছি।"
--- আমরা কালী মন্দিরে দুই বোনে দুটো ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছি। আমাদের রেজিস্ট্রি আগেই হয়ে গেছিল।
 --- ছেলে দুটো কে? আমি কি চিনি?
--- হ্যাঁ চিনিস। তুই যেখানে গানের রিহার্সালে যাস তার উল্টোদিকে গ্যারাজ আছে, গ্যারাজটার নাম "সনাতনদার গ্যারেজ"। ঐ গ্যারাজের মালিক সনাতনদাকে আমি বিয়ে করেছি। আর তার পাশেই যে মোবাইলের খুব বড় দোকানটা আছে "আকাশবাণী" নামের, ঐ আকাশবাণীর মালিক মানিকদাকে আয়ুষা বিয়ে করেছে।
--- কিন্তু ওরা তো তোদের থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো। দেখতেও খুব একটা সুশ্রী নয়, দুজনেরই গায়ের রং কালো।
--- হ্যাঁ, তেরো চৌদ্দ বছরের বড়। তাতে কি হয়েছে দিদি! আর গায়ের রং কালো তো কি হয়েছে অকর্মণ্য তো নয়। শোন দিদি আমরা দিন সাতেক এখানে থাকবো তারপর ফিরবো। প্রত্যেক দিন তোকে ফোন করবো, বা তুইও এই নম্বরে ফোন করতে পারিস।"
            ফোন কেটে গেল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অতি বাস্তব "অকর্মণ্য তো নয়" কথাটা শেলের মতো বুকে বিঁধে গেল। মা আমাকে নাড়া দিয়ে বললো, "কী বলল বল!"
আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে যা শুনলাম তাই বললাম। সাথে যোগ করলাম "ছেলে দুটো খুব ভালো, করিৎকর্মা। বোনদের খাওয়া-পরা, শখ-সাধের অভাব হবে না।"
            মা ছেলে দুটোকে না চিনলেও বাবা বিলক্ষণ চেনে। বাবা রক্ষনশীল মনোভাবের, তাই এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে বুকে ব্যথা শুরু হলো। আমি কাল বিলম্ব না করে আমার গানের টিমের ছেলেদের সাহায্যে বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করালাম। বোনদেরও সাথে সাথেই খবর দিলাম। বাবাকে বাঁচানো গেল না, পরদিনই মারা গেল। আর বাবার শ্রাদ্ধ-শান্তির দুদিন আগে মারা গেল মা। আমার গানের টিমের সকলে, বোনদের বরেদের সহায়তায় দাহ, শ্রাদ্ধশান্তি সব সুষ্ঠ ভাবে চুকে গেল।



( ক্রমশ........)

         ~ হর্ষময় মণ্ডল
© Copyright Protected



Post a Comment

1 Comments

Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)

Close Menu