Ad Code

.
.
1 / 8
2 / 8
3 / 8
4 / 8
5 / 8
6 / 8
7 / 8
8 / 8

এতটুকু প্লাস্টিকও আর নয় | কলমে ~ ডঃ রমলা মুখার্জী | নীরব আলো


'প্লাস্টিক বর্জন করতে হবে' এই স্লোগান মুখে বলা যতটা সোজা, কাজে করা ঠিক ততটাই কঠিন। কারণ প্লাস্টিক যেভাবে আমাদের জীবনে জড়িয়ে পড়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যে ট্রুথব্রাশ দিয়ে সকাল শুরু হয়, যে বালতি ব্যবহার করে স্নান সারি, যে সিন্থেটিক পোষাক বা বর্ষাতি পরে কাজে বেরোই, যে ডিশে খাদ্য খাই, বাসে-ট্রেনে যে সব সিট ব্যবহার করি, যে সব প্যাকেটে খাবার নিয়ে যাই, যে সুইচ, ফ্রিজ, টিভি ব্যবহার করি, এমনকি রাতের মশারিটা পর্যন্ত প্লাস্টিক বা কোন না কোন পলিমারজাত পদার্থ দিয়ে তৈরী। প্লাস্টিকের বহু সুবিধাজনক ব্যবহার থাকলেও এর সব থেকে বড় অসুবিধা হল এটি ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ নয়; মানে এটি বিশ্লিষ্ট হয়ে প্রকৃতিতে মিশে যায় না। তাই যত প্লাস্টিক এতদিন পর্যন্ত তৈরী হয়েছে তা সমস্তই প্রকৃতিতে জমে জঞ্জালের স্তুপ হয়ে উঠেছে। একটুও তা ধ্বংস হয় নি। এমনকি মহাকাশ পরিক্রমাকালে প্লাস্টিক মহাকাশেও দূষণ ছড়াচ্ছে। 
           রাস্তা-ঘাটে, দোকান-বাজারে, নালা-নর্দমায় যেখানেই চোখ পড়ে সেখানেই দেখতে পাওয়া যায় প্লাস্টিকের জঞ্জাল। নর্দমায় জমে নর্দমার মুখ বন্ধ করে দিয়ে জল-নিকাশি ব্যবস্থাকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে প্লাস্টিক। মাটিতে প্লাস্টিক মিশে যাওয়ার ফলে গাছের মূল বাড়তে পারছে না। গর্তবাসী বা মাটিতে বসবাসকারী প্রানীদেরও ক্ষতি হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ফোরামের সমীক্ষা অনুযায়ী সমুদ্রে এই মুহূর্তে পাঁচটি মাছ পিছু একটি করে প্লাস্টিক রয়েছে। ২০৫০ সালে তা বেড়ে একটি মাছ পিছু একটি প্লাস্টিক হয়ে দাঁড়াবে। মাছেরা পাতলা প্লাস্টিকের ছোট ছোট অংশ খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলে। পাকস্থলী, অন্ত্রে প্লাস্টিক জমে প্রচুর জলজ প্রাণীর মৃত্যু-ঘণ্টা বাজছে। 
           ২০১১ সালে ভারত সরকারের তৎকালীন পরিবেশ ও বন-মন্ত্রক দপ্তর থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য মোকাবিলা সম্পর্কিত নিয়মাবলী বহাল হলেও কিছু সমস্যার কারণে ২০১৬ সালে পুনরায় প্লাস্টিকজাত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সম্পর্কে নিয়মাবলী চালু করা হয়। এই নিয়মাবলীতে ৫০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিক তৈরী ও রঞ্জক পদার্থ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। খোলা আকাশের নীচে প্লাস্টিক পোড়ানো একদমই নিষিদ্ধ হল কারণ প্লাস্টিক দহনে যে গ্যাস উৎপন্ন হয় তা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। প্লাস্টিক হল কিছু যৌগের পলিমার; এই যৌগগুলি মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া করে। প্লাস্টিকের বোতলে বহুল ব্যবহৃত বিসফেনল 'এ' থ্যালেট প্রজনন তন্ত্রের ক্ষতি করে। প্লাস্টিকের কাপে চা খেলে তা থেকে যে ডাই-অক্সিন শরীরে ঢোকে তা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মেয়েদের বন্ধ্যাত্ব হয়। 
              এখন একথা ভাববার সময় এসেছে যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক স্থলভাগ, জলভাগে জমছে সেগুলি কিভাবে পুনরায় কাজে লাগানো যায়। সম্প্রতি গবেষণায় জানা যায় যে নানাভাবে বয়ে নিয়ে প্লাস্টিক নদীতে ফেলার কৃতিত্বে বিশ্বের মধ্যে গঙ্গার স্থান দ্বিতীয়। গবেষকদের মতে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, দ্রুত নগরায়নে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রবল বৃষ্টি, নদীপথে বেশি জলাধার, বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের সুবন্দোবস্ত না থাকা ইত্যাদি জলদূষণের অন্যতম কারণ। গবেষকদল আরও উল্লেখ করেছেন জাহাজ, নৌকা, সমুদ্রতট থেকেও প্লাস্টিক সমুদ্রে পড়ছে; তবে স্থলভাগ থেকেই বেশিরভাগ প্লাস্টিক সমুদ্রে যাচ্ছে।
              প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া জিনিস পুনরায় ব্যবহার বা রিসাইক্লিং করা সম্ভব হলেও তা হয় নিম্নমানের, তাই প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হল ডাউন সাইক্লিং। অবশ্য রিসাইক্লিং করা প্লাস্টিক দিয়ে বালতি, মগ, নিকাশি নালার পাইপ, চেয়ার, টেবিল, খেলার সামগ্রী, জ্যাকেট, জুতো অনেক কিছুই বানানো সম্ভব। কিছুদিন আগে বিশ্বের নামকরা একটি স্পোর্টস সংস্থা জানিয়েছে তারা ভার্জিন প্লাস্টিক ব্যবহার না করে সমুদ্রের ধারে পড়ে থাকা প্রচুর নোংরা প্লাস্টিকগুলিই পরিষ্কার করে ব্যবহার করবে। এটি অবশ্যই বর্জ্য প্লাস্টিক পরিষ্কারের একটি সুস্থ ও প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। কারণ প্লাস্টিকের জিনিসপত্র তৈরীর কাঁচামাল এখানে প্রকৃতি থেকে লাগছে না উপরন্তু ডাঁই করা প্লাস্টিকগুলির অপসারণও সম্ভব হচ্ছে সুস্থভাবে।
প্লাস্টিক রিসাইক্লিং-এর আর একটি পদ্ধতি হল ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে প্লাস্টিক দানা তৈরী করে তা থেকে নানা ধরণের জিনিসপত্র তৈরী করা। ব্যবহৃত বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি বা শক্তি উৎপাদনও সম্ভব। এ ব্যাপারে প্রচুর গবেষণা চলছে নানা দেশে। বর্তমানে রাস্তা তৈরীর কাজে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার হচ্ছে। এক টন প্লাস্টিক থেকে ১ মিটার দীর্ঘ এবং ৩.৭৫ মিটার প্রস্থের রাস্তা তৈরী সম্ভব। 
            দুঃখের বিষয় হল পাতলা প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ হলে কি হবে তা কিন্তু নানাভাবেই আমাদের ঘরে ঢুকছে; আবার আনাজের খোসা, ময়লা আবর্জনা এইসব প্লাস্টিকে ভরেই আমরা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলছি অর্থাৎ প্লাস্টিক দূষণের সূচনা ঘর থেকেই শুরু হচ্ছে। পাতলা পলিব্যাগগুলি কেটে দড়ি তৈরী করে ক্রুশ দিয়ে বুনে ঘর সাজানোর নানা জিনিস তৈরী করা যায়। তুলোর পরিবর্তে পাতলা প্লাস্টিক ব্যবহার করে সফট টয়েজও বানানো যায়।
            এবারে আসা যাক অন্য একধরণের প্লাস্টিক মোড়কের কথায়। বিস্কুট, চানাচুর, চিপস পাওয়া যায় নানান চিত্তাকর্ষক প্লাস্টিকের মোড়কে। মুচমুচে রাখার জন্য মোড়কের ভিতরের দিকে থাকে রূপালি আস্তরণ। এই ধরণের প্লাস্টিক মাটির সঙ্গে মোটেই মেশে না, উপরন্তু কোনভাবেই রিসাইক্লিং হয় না কারণ বেশির ভাগ চিপসের প্যাকেট তৈরী হয় পলিপ্রপাইলিন ও অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ জুড়ে। তাই এইধরণের প্যাকেট যেখানে সেখানে না ফেলে আলাদা করে রাখা অত্যন্ত জরুরী। রূপালি অংশটি রাংতার পরিবর্তে ব্যবহার করে গয়না, খেলনা, মঞ্চ সাজানো, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র ইত্যাদি তৈরী করতে অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারি। আমরা যদি সবাই সচেতন হই তাহলেই ‘প্লাস্টিক বর্জন’ করতে পারব। ভবিষ্যতে নতুন করে আর কোন প্লাস্টিক ব্যবহার নয় এই শপথ শুধু মুখে নয় কাজে করে ফেলতে না পারলে নিজেদের রচিত প্লাস্টিকের কারাগারে আমরা সবাই বন্দী হয়ে মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাব। তাই পরিশেষে বলি, সাবধান হন, সতর্ক হন আর অবশ্যই প্লাস্টিক বর্জন করুন।

       ~ ডঃ রমলা মুখার্জী 
© Copyright Protected

Post a Comment

0 Comments

Close Menu