সকাল দশটা পনেরোর বাসটা যদি সময় মতো ছাড়ে, তাহলে সাড়ে এগারোটার ক্লাসটা নিতে অমৃতার কোনো অসুবিধেই হয় না। বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি যেতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে যায়। যাদবপুরগামী এই সময়ের এই বাসটিতে কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং অফিসযাত্রীর সংখ্যাই বেশী। অনেকদিন এমনও হয়েছে তার সঙ্গেই সেই বাসেই একই সাথে যাত্রা করেছে তারই ক্লাসের ছাত্র। সৌজন্যের খাতিরে বাসের টিকিট অমৃতাই কেটেছে। নিত্যদিনের এই বাসযাত্রায় অমৃতা মুখিয়ে থাকে পথচলতি মানুষদের টুকরো কথায় বা আচরণে মজার কিছু উপাদান সংগ্রহে। তাদের হাবভাব, চালচলন, সহযাত্রীদের সঙ্গে বার্তালাপে সে এক নিমেষেই পড়ে ফেলতে পারে অপরিচিত মানুষদের। এটি তাকে এক অন্যরকম আনন্দ দেয়।
সেদিন ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল সে। বাড়ির কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকেই তার দশটা পনেরোর বাস ছাড়ে। একটু আগে থাকতে গেলে, তার বরাদ্দ সিটটা সে অনায়াসেই পেয়ে যায়। সেদিনও তার অন্যথা হল না। জানলার ধারে একটু গুছিয়ে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, এদিক ওদিক তাকিয়ে এক ঝলকে দেখে নিল সে সহযাত্রীদের। একই সময়ে একই বাসে যাওয়া, তাই পরিচিত মুখের সংখ্যাই বেশী। নজর কাড়ে দরজার সামনে জানলার পাশে বসা বৃদ্ধ লোকটি। আধময়লা সার্ট, চুলগুলো উস্কোখুস্কো, কাঁধে শান্তিনিকেতনী পুরনো একটা ঝোলা ব্যাগ, ডান হাতের কবজিতে একটা সস্তা দামের ঘড়ি, কাঁচাপাকা দাড়িতে তোবড়ানো গালটা কিছুটা ঢাকা পড়েছে; কিন্তু চোখ দুটো আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল। সপ্রতিভ চাহনিতে যেন জরিপ করছেন বাসের সকলকে।
অন্যদিনের তুলনায় আজ যাত্রী কম।আগামীকাল পনেরোই অগস্ট, পরশু রবিবার। তাই অনেকেই আজ একদিনের ছুটি নিয়ে, টানা তিনদিনের ছুটির ফায়দা নিয়েছে।
বাস নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ার খানিক পরেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি আচমকা তাঁর সামনের সিটে বসা মহিলাকে শুধান, "দিদিভাই, একটা কথা জানার ছিল, বলতে পারেন, আমাদের জাতীয় পতাকায় যে অশোকচক্র তাতে কতগুলো কাঁটা আছে?" মহিলা অপ্রস্তুত, এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষমেশ হাল ছাড়লেন। বৃদ্ধ দমে যাওয়ার পাত্র নন, তার পাশের যুবকটিও রেহাই পেল না তার এই প্রশ্নের হাত থেকে। নাগালের মধ্যে যে কজনকেই পেলেন, তিনি একই প্রশ্নবাণে আহত করলেন প্রায় সকলকেই। কিন্তু সদুত্তর এল না কারো কাছ থেকেই। টিকিট কাটতে কন্ডাক্টর এগিয়ে এলে, তাকেও সেই একই প্রশ্ন- "বলতে পারো ভাই, আমাদের জাতীয় পতাকায় ........।" মাঝপথেই কন্ডাক্টর ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "আপনি দাদু একটু চুপটি করে বসুন তো, বড়ো জ্বালাতন করছেন সবাইকে। এ আপনার কী প্রশ্ন! চেনা নেই, জানা নেই, যাকে তাকে এইভাবে ব্যতিব্যস্ত করা।"
-- "কিন্তু ভাই, আমার যে এটা জানা খুব দরকার।"
অমৃতা একটু দূরে থাকায় বৃদ্ধের প্রশ্নবাণ তাকে এখনও বিদ্ধ করতে পারে নি। গোটা ঘটনাটা সে দূর থেকে উপভোগ করছে। দশ মিনিট হল বাসটা জ্যামে আটকে আছে। এই ফাঁকেই বছর বারোর একটা ছেলে লাফ দিয়ে বাসে উঠল। হাতে প্লাস্টিকের বানানো কিছু পতাকা। কাল স্বাধীনতা দিবসে কেউ গাড়ি সাজাবে, বাড়ি সাজাবে- তাই যদি কিছু বিক্রি হয়, এই আশায়। বৃদ্ধ তাকেও বাদ দিলেন না, "বলো তো খোকা, আমাদের জাতীয় পতাকায় ........"। ছেলেটির চটজলদি উওর ২৪ টা।বৃদ্ধের চোখে দীপ্তি খেলে গেল উওরটা পেয়ে।
-- "জানলে কি করে?"
-- "গুণে দেখেছি যে।"
-- "এতক্ষণে তুমিই একমাত্র উওরটা দিলে যখন, বাকিটুকুও জেনে নাও তাহলে।"
এই বলে ছেলেটিকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বৃদ্ধ বলে চলেন, "জানো এই ২৪ টার মানে কী? বলি, তবে শোনো- অশোকচক্র হল একটি ধর্মচক্র, যা হিমালয়ের ২৪টি ঋষির প্রতিনিধি। শুরুতেই আছেন ঋষি বিশ্বামিত্র এবং শেষে যাজ্ঞবল্ক্য মুনি। এছাড়া, যেহেতু একটি দিনে ২৪ ঘন্টা থাকে, তাই এটি একটি কর্মের প্রতীক, যা দৈনিক নিরলস কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়। আরো আছে, - ২৪ টি কাঁটা একেকটি একেক মানে বহন করে, যথা-
১৷ শুদ্ধতা ২৷ স্বাস্থ্য ৩৷ শান্তি ৪৷ আত্মত্যাগ ৫৷ নৈতিকতা ৬৷ সেবা ৭৷ ক্ষমা ৮৷ ভালোবাসা ৯৷ বন্ধুত্ব ১০৷ ভ্রাতৃত্ব ১১৷ সংগঠন ১২৷ কল্যাণ ১৩৷ উৎকর্ষ ১৪৷ শিল্প ১৫৷ নিরাপত্তা ১৬৷ সচেতনতা ১৭৷ সমতা ১৮৷ অর্থ ১৯৷ নীতি ২০৷ বিচার ২১৷ সহযোগিতা ২২৷ কর্তব্য ২৩৷ অধিকার এবং ২৪৷ জ্ঞান, বুঝলে খোকা! এই চাকার ওপর ভর করেই যে আমাদের জীবন চলছে, আমাদের দেশও যে তাই।"
বাস সুদ্ধ লোক অবাকদৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে থাকে। যাদবপুর এসে গেছে। বাস প্রায় খালি এখন। নামতে গিয়েও অমৃতা কৌতুহল দমন করতে পারল না, এগিয়ে গেল বৃদ্ধের দিকে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে চাইতেই তিনি বলেন- "বুঝলে মা, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপক। দেখলে তো চোখের সামনে, এই তো দেশের হাল! বলতে পারো, একটু কৌতুক করলাম সবার সঙ্গে। আধুনিক প্রজন্ম দেশের সম্পর্কে কতটুকুই বা জানে। 'অলিম্পিকে' পদক জিতলে সেই নিয়ে মাতামাতি, আসল জায়গায় সব ফাঁকা। ভালো থেকো মা। আমার কিছু ছাত্রদের আমন্ত্রণে ইউনিভার্সিটির একটি সেমিনারে মুখ্য অতিথি হিসেবে আসতে হল আজ।"
এই বলে অধ্যাপক এগিয়ে গেলেন। অপলক দৃষ্টিতে অমৃতা চেয়ে থাকে বৃদ্ধের চলে যাওয়া পথের দিকে।
0 Comments