ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নারী শিক্ষার প্রসারে যে সকল মহাপুরুষ অগ্ৰগন্য তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন যুগে নারীদের শিক্ষা এবং তাঁরাও ছেলেদের ন্যায় স্কুলে যাবে এটা অকল্পনীয়। বিদ্যাসাগর নিজ অর্থে নারী শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র একজন পণ্ডিত ব্যাক্তি বা সমাজসংস্কারক ছিলেন না একজন নির্ভীক দার্শনিকও ছিলেন। তিনি জানতেন, একটা ডানায় পাখি উড়তে পারে না, সেরকমই সমাজের অর্ধেক শিক্ষিত মানুষ নিয়ে একটা সম্পূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা যাই না।
১৮৪৯ সালের ৭ই মে বেথুন সাহেব কলকাতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমান কালে যা বেথুন স্কুল নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন, এই কাজে বিদ্যাসাগর তাঁকে সহযোগিতা করেন এবং ১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় এই স্কুলের সম্পাদক হন। তিনি স্কুলের (বেথুন স্কুল) ছাত্রীদের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়ার গাড়িতে লিখেছিলেন "কন্যাপ্যেবং পালনীয় শিক্ষনীয়াতি যত্নতঃ।" এর অর্থ হল পুত্রের ন্যায় কন্যাসন্তানকে পালন ও যত্ন সহকারে লেখা-পড়া শেখাতে হবে। বিদ্যাসাগর মহাশয় বেথুন স্কুলের জন্য ছাত্রী যোগাড় করে দিয়েছিলেন। যেমন - দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সৌদামিনী ও মদনমোহন তর্কালংকারের দুই মেয়ে ভুবনমালা ও কন্দনমালা কে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে বেথুন স্কুলে ভর্তি করান। তাঁর অনুরোধের ফলে অনেক অভিজাত বাড়ির মেয়েরা বেথুন স্কুলে পড়তে আসে। ১৮৫৪ সালের 'উডের ডেসপ্যাচে' স্ত্রী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিলে তিনি এর সমর্থন করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন রামকৃষ্ণ দেব -
"কাল নয়, নালা নয়, প্রকৃতই সাগর ।"
বিদ্যাসাগর নিজেও নারী শিক্ষার অগ্ৰগতির জন্য অনেক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং সেগুলির খরচ চালাতেন।১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্কুল ইন্সপেক্টার রূপে নিযুক্ত হয়ে নারীশিক্ষায় জোয়ার আনেন।১৮৫৭ থেকে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মাত্র ১ বছর সময়ে তিনি বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, বীরভূম, ২৪পরগনা ও মেদনীপুরে মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং এই বিদ্যালয় গুলিতে ১৩০০ ছাত্রী পড়াশোনা করত এবং তিনি তাদের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে ৩৪০০টাকা খরচ করতেন।
শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগর শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্য জেলায় জেলায় মডেল স্কুল গড়েছিলেন- বিদ্যালয় পিছু মাসে ৫০.০০ টাকা করে খরচ পড়ত। এখানে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের ও বিনামূল্যে পড়ানো হত যেমন ---
স্থান প্রকৃতি সময়
গোপালনগর মডেল স্কুল ১৮৫৫
বাসুদেবপুর ,, ,,
জকপুর ,, ১৮৫৬
মালঞ্চ ,, ১৮৫৫
প্রতাপপুর ,, ১৮৫৭
নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি জেলায় ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনটি বালিকা বিদ্যালয় গড়েছিলেন --
গ্ৰাম ভাঙাবদ্ধ বালিকা বিদ্যালয় ------ ৩০ টাকা
বদনগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়------৩১ টাকা
শান্তিপুর বালিকা বিদ্যালয়-------২০ টাকা
এগুলি হল বিদ্যালয় গুলির মাসিক খরচ।
নিজ জন্মভূমি বীরসিংহ গ্ৰামে তিনি একটি অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয় ১৮৫৩ সালে গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮৯০ সালের ১৪ই এপ্রিল তিনি এই বিদ্যালয়ের নাম দিয়েছিলেন 'ভগবতী বালিকা বিদ্যালয়' মাতৃ স্মৃতি রক্ষার্থে। তাঁর রক্ষনাবেক্ষনের পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ করার সময় সহোদর শম্ভুচন্দ্রকে একটি পত্রে বলেছিলেন--
"............. স্কুল বাটি নির্মানের জন্য দশ হাজার টাকা রাখ।"
(বিদ্যাসাগর জীবন চরিত:- শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন)
ঐতিহাসিক যোগেশ চন্দ্র বাগল বলেছেন "নারী জাতির শিক্ষা বিস্তারে তিনি শুধু আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেননি, নিজের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করেছিলেন।" ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন(বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) উচ্চ নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রতিষ্টা করেন। তার রোপিত নারী শিক্ষার বীজ যা আজ মহীরুহ তে
পরিণত হয়েছে তাই তিনি আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয়।
ঋণ স্বীকার :
(১) বিদ্যাসাগর জীবন চরিত- শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন
(২) উইকিপিডিয়া
(৩) বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।
~ সন্দীপ কুমার পণ্ডা
© Copyright Protected
0 Comments