Ad Code

.
.
1 / 8
2 / 8
3 / 8
4 / 8
5 / 8
6 / 8
7 / 8
8 / 8

নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা | কলমে ~ ডাঃ হর্ষময় মণ্ডল | নীরব আলো

নারী হোক বা পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষা চাই। সেই শিক্ষার পাঠ শুরু করতে চাই উপযুক্ত পাঠক্রমের বই। সেই চাহিদা মিটিয়ে ছিলেন বিদ্যাসাগর। মাতৃদুগ্ধের সাথে সাথে বাঙালির শৈশব গড়ে উঠেছে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ২৬শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তারপর থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই পর্যন্ত ৭১ বছর বয়সের জীবনে রেখে গেছেন স্বরচিত বহু বই। সব বইগুলি বাংলা ভাষায়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করার প্রয়োজনীয়তা। তিনি বাংলা ভাষায় মৌলিক ও অনুবাদ রচনা করেন। তিনি আরও উপলব্ধি করেছিলেন, ছেলেদের জন্য স্কুল আছে, মেয়েদের জন্যেও স্কুল চাই। ঘরের মেয়েদের, নারীদের স্কুলের আঙ্গিনায় আনতে হবে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে না পারলে দেশের ও জাতির উন্নতি হবে না, কারণ বাচ্চাদের শৈশবকাল মায়েদের কাছেই কাটে। তাই নারী শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। 
        বিদ্যাসাগরের জন্মকাল থেকে নারী শিক্ষার স্কুল ছিল না এমন নয়। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে মিশনারীরা 'ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি ফর দা এস্টাবলিশমেন্ট এন্ড সাপোর্ট অফ বেঙ্গলী ফিমেল স্কুল' চালু করেছিলেন। এরপর বিশিষ্ট জমিদার ও ব্যক্তিদের সহযোগিতায় নন্দিবাগান, গৌরবাজার, চিৎপুর অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ১৮২৯ সালে ওই সোসাইটি আরো ২০টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে সব স্কুলগুলি আর্থিক ও খিস্ট ধর্মমূলক বই পড়ানোর জন্য মুখ থুবড়ে পড়ে। 'লেডিস অ্যাসোসিয়েশন' বন্ধ হয়ে যায়। নারী শিক্ষা বিষয়ে যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল তারই সূত্র ধরে জনমত ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছিল। এরপর ১৮৪৭ সালে বারাসাতে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। আরো একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে। ড্রিংক ওয়াটার বেথুন স্থাপন করেন, এবং নাম দেন 'ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল'। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর অবৈতনিক সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে বেথুন সাহেবের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর স্কুলটির নাম দিলেন 'বেথুন স্কুল'। বিদ্যাসাগর দেখলেন শুধু কলকাতায় নয় সমস্ত গ্রামেগঞ্জে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। ১৮৫৪ - ৫৭  খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হুগলিতে ২টি ও বর্ধমানে ২টি স্কুল স্থাপন করলেন, ৪টিই সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত। বিদ্যাসাগর বিপুল উদ্যমে ও পরিশ্রমে বাংলার গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে ৪০টির মত বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সরকার সমস্ত স্কুলের আর্থিক সাহায্য দিলেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগর দমলেন না, বিদ্যালয়গুলি চালাতে লাগলেন। এতে তার ব্যক্তিগত ঋণ হলো প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পুরোপুরি দরিদ্র ছাত্রদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেছিলেন। এত দরিদ্রতা সত্ত্বেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলেন না। অনেক সুহৃদয় ব্যাক্তিবর্গের সহায়তায় চালাতে লাগলেন। অনেক বিদগ্ধজন বিরুদ্ধাচারণও করেছিলেন কিন্তু বিদ্যাসাগর কর্ণপাত করেননি। এতো দিকে কর্মকাণ্ড তারপর আরো সমাজ সংস্কারমূলক কাজ, যেমন- বাল্যবিবাহ রোধ ,বহুবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ চালু করা, প্রভৃতি নিয়ে কর্মব্যস্ত হয়ে যাওয়ার ফলে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকুরি ছেড়ে দিলেন। নির্দিষ্ট রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেল‌। বন্ধ হলে কি হবে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্যে গড়ে তুললেন 'নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভান্ডার' ও মন প্রাণ ঢেলে দিলেন নারীশিক্ষা আন্দোলনে।
        ১৮৫৭ থেকে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের শুরুর থেকে ৪০টি স্কুলের শিক্ষকরা মাইনে পান নি, এত টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। তাই বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে আবেদন ক্রমান্বয়ে চালাচ্ছিলেন। অনেক চিঠি চাপাটির পর বিদ্যাসাগরকে ভারত সরকার ঋণমুক্ত করেন। এই কাজে যুক্ত হন হেলিড সাহেব। তিনি 'মিনিট' জমা দিলেন। তার কিছুদিন পরে ভ্যালিড ছোটলাট পদ পান ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগরকে স্পেশাল ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত করেন। এ ছাড়াও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে 'বোর্ড অফ কন্ট্রোল' সভাপতি চার্লস উড ভারতের শিক্ষা সম্বন্ধে 'ডেসপ্যাচ' পাঠান এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান গুরুত্ব দেন ও গ্রান্ট- ইন -এড হয়- যেটা বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন। এই সবই বিদ্যাসাগরের পরিশ্রমের ফল। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রীর সংখ্যা হয় ২৭৩৮ জন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে নারী শিক্ষা বিস্তারে মিস মেরি কার্পেন্টার বিলেত থেকে কলকাতায় এলেন। একটি কমিটি গঠন করা হয় বেথুন স্কুলে। একজন দেশী শিক্ষয়িত্রী গড়ে তোলার জন্য 'মহিলা নর্মাল স্কুল' খোলা হল। এরপর বিদ্যাসাগর ১৪ই ডিসেম্বর ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে যে বগি গাড়ি চড়ে স্কুল পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন, সেই গাড়ি উল্টে যায় ও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
        বিদ্যাসাগর এই নারী শিক্ষার আন্দোলনের সাথে সাথে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত আন্দোলনে নেমে পড়লেন। এই সময় একজন পুরুষ অতি বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বহু বিবাহ করত, এমনকি শিশুকন্যা পর্যন্ত। তাই সেই সব মেয়েরা অল্প বয়সে বিধবা হত। তিনি আইন করে সে সব রোধ করলেন। সমাজের প্রতি, নারী জাতির প্রতি কতটা মমতা ভালবাসা ও সংবেদনশীল হলে এ কাজ করতে পারা যায় তা ভাবার বিষয়।
        ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে 'বেথুন স্কুল' শিক্ষা দপ্তরের হাতে চলে গেল। বিদ্যাসাগর কাগজপত্র বুঝিয়ে ও প্রয়োজনে সবরকম সাহায্য করবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরে এলেন। বিদ্যাসাগর নারী জাতিকে এতটাই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন যে, যে ঘোড়ার গাড়ি করে ছাত্রীদের বেথুন স্কুলের আনা হতো তিনি তাতে একটি শাস্ত্র বচন খোদাই করে দিয়েছিলেন। তা হল - "কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়তি যত্নতঃ" অর্থাৎ "কন্যাকেও যত্ন করে পালন করতে ও শিক্ষা দিতে হবে"। ফলের আশা না করে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন- "আমাদের দেশে প্রায় অনেকেই নিজের এবং স্বদেশের মর্যাদা নষ্ট করিয়া ইংরেজদের অনুগ্রহ লাভ করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সাহেবের হস্ত হইতে শিরোপার জন্য কখনও মাথা নত করেন নাই।"
        এইবার বই রচনা দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে 'সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা' এবং তার দুই বছর পরে লিখলেন 'ব্যাকরণ কৌমুদী'। তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ ১৮৫৪ ও ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে 'শকুন্তলা' লিখলেন। বইটি বাঙালির মনে সাড়া ফেলেছিল। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি বই বের হলো। 'বর্ণপরিচয়' প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে দীর্ঘ ঋ ও দীর্ঘ ৯ কারের প্রয়োগ না থাকায় তা বর্জন করেন। ৫০ থেকে ৪৮ টি অক্ষর হল। এবং বিসর্গ (ঃ) যা এতদিন স্বরবর্ণ বলে বিবেচিত হতো এখন থেকে বিদ্যাসাগর তাদের ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তর্ভুক্ত করলেন এবং চন্দ্রবিন্দুকে (ঁ) ব্যঞ্জনবর্ণের স্থল থেকে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলে স্বীকৃতি দিলেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে 'কথামালা', 'ঈশপ ফেবলস' থেকে অনুবাদ করলেন 'চরিতমালা'। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে উত্তরচরিত রামায়ণের উত্তরাখন্ড অবলম্বনে রচনা করলেন 'সীতার বনবাস'। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে 'ভ্রান্তি বিলাস', 'কমেডি অফ ইরর' থেকে অনুবাদ করেন। ১৮৭১ ও ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে দুটি বই 'বহুবিবাহ রোহিত উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার' ও 'বহুবিবাহ রচিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার'। এছাড়াও 'ভূগোল খগেলিবর্ণনম' রচনা করেন। বিনয় ঘোষের মতানুসারে জানা যায় ২৭ টি বই বিদ্যাসাগর রচনা করেন।
        মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী জীবনে যিনি চিরস্থায়ী কাজ করে যান তিনি অমর। বিদ্যাসাগর জীবনে কখনো সুখ বিলাসিতা ভোগ করেন নি। দেশ ও দশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। এত রকম আন্দোলন, এত স্কুল স্থাপনের মধ্যেও এতগুলি বই রচনা করেছেন। পরিশেষে একটা কথা বলি, তিনি কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। সারহীন ধর্মে, যেখানে ভগবান একটা অলীক বস্তু, যার দেখা কেউ পায়নি, বা পেলেও জনে জনে দেখাতে পারেনি, তাতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি কর্মের দ্বারা, বই রচনা, নারী শিক্ষা, বহুবিবাহ রোধ, বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবা বিবাহ চালু করেন ও স্কুল স্থাপন করেন মহিলাদের জন্য যা জনে জনে যুগ যুগ ধরে দেখেছে, দেখছে, দেখবে। তিনি বলতেন পরিশ্রম=শস্য, পরিশ্রম + প্রার্থনা=শস্য, প্রার্থনা = শূন্য (০)।

       ডাঃ হর্ষময় মণ্ডল
© Copyright Protected

Post a Comment

1 Comments

  1. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)

Close Menu