Ad Code

.
.
1 / 8
2 / 8
3 / 8
4 / 8
5 / 8
6 / 8
7 / 8
8 / 8

বিদ্যাসাগর ও শিক্ষাব্যবস্থার নতুন পরিকাঠামো | কলমে ~ মৃণাল কান্তি দেব | নীরব আলো


ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতবর্ষ। অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, আর গোঁড়ামির বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন অবিভক্ত বঙ্গদেশ। নবজাগরণ এলেও সেই নবজাগরণের উজ্জ্বল কিরণ দেখতে অক্ষম ছিলো বাংলা। গাঢ় নিকষ আঁধারে মোড়া চতুর্দিক-- আর এই গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, দূষিত সব চিরাচরিত প্রথার অন্ধকার কুয়াশার মধ্য থেকে আবির্ভূত হলেন এক মনীষী, এক মহামানব, এক দৃঢচেতা সমাজসংস্কারক-- যিনি প্রকৃত শিক্ষার অভ্রভেদী রথের সাহায্যে ভেঙেছিলেন অন্ধকার অভিশপ্ত কুয়াশাচ্ছন্ন কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীর। যিনি গড়তে চেয়েছিলেন সুশিক্ষিত সভ্য সমাজ, যিনি জাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন প্রকৃত মনুষ্যসমাজের।
        কেউ কি ভেবেছিলেন বীরসিংহের সেই শিশু একদিন হয়ে উঠবে সিংহশিশু, হয়ে উঠবে বিদ্রোহী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, হয়ে উঠবে শিক্ষাজগতের এক ধ্রুবতারা, হয়ে উঠবে সর্বহারা মানুষদের আশার আলো? হ্যাঁ, সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন অসহায়, নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষদের ঈশ্বর- রক্ত মাংসের ঈশ্বর। হয়ে ওঠেন প্রকৃত শিক্ষা আর বিদ্যার সাগর।
        আজ এতগুলো যুগ পেরিয়ে এসেও তিনি আমাদের কাছে আজও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। মাঝে মাঝে শুধু ভাবি, উনি না থাকলে সত্যিই কি আমরা এগোতে পারতাম? না, পারতাম না-- পারলেও এতটা পারতাম না। সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগর, মানবপ্রেমী বিদ্যাসাগর, নারীশিক্ষার বীজ বপনকারী বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখা উচিৎ আধুনিক শিক্ষার রূপকার বিদ্যাসাগরকে। ভাবলে অবাক হতে হয় আজ থেকে বহু যুগ আগেই বীরসিংহের সিংহপুরুষ পত্তন করেছিলেন প্রকৃত সমাজ গঠনকারী আধুনিকার শিক্ষার স্তম্ভ। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, পঠনপাঠন রীতি আর মনুষ্যজীবনে সেই সমস্ত শিক্ষার সুনিপুণ প্রয়োগের দিকে তিনি জোর দিয়েছিলেন।
        বিদ্যাসাগর মশাই তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। প্রথম থেকেই তিনি শুরু করলেন যুগোপযোগী অথচ তীব্র সমাজবোধ সৃষ্টিকারী বিষয়। শুধুমাত্র পুস্তকের মাধ্যমে ভেদাভেদহীন সমাজ গঠন করার কথা না শিখিয়ে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ভেদাভেদহীন, বৈষম্যহীন করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। একটা কথা এ বিষয়ে বলা ভীষণভাবে প্রয়োজন, তা হল- বিদ্যাসাগর মশাইয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজবাদী চিন্তাধারা। "সকলের জন্য শিক্ষা"এই বিষয়টাকে তিনি সমাজের অন্তঃসলিলে প্রোথিত করেন। আবার সিলেবাসের মধ্যেও আনেন বিপুল পরিবর্তন। একটা সময় বীজগণিত, সাধারণ গণিত ও ব্যাকরণ শেখানো হতো সংস্কৃতে। বিদ্যাসাগর মশাই এই সিস্টেমের অবসান ঘটিয়ে ব্যাকরণকে বাংলায় আর গণিতকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো শুরু করেন। আধুনিক গণিত শিক্ষার উন্নতিসাধন ও নিজ ভাষার মাধুর্যে সিক্ত হয়ে সঠিক ব্যাকরণ শিক্ষা, মূলত এই দুটি কারণেই এই রদবদল ঘটান তিনি। তবে যুগান্তকারী পরিবর্তন তিনি এনেছিলেন দর্শন শাস্ত্রে। বেদান্ত এবং সাংখ্য দর্শনকে তিনি বরাবরই মনে করতেন ভ্রান্ত আর প্রাচীনপন্থী। বার্কলের দর্শনের পরিবর্তে তিনি পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করেন বেকনের দর্শন। ঠিক এখানেই বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অভিনবত্ব, মৌলিকত্ব। প্রাচীন কালের শিক্ষাধারা যদি আধুনিক, উন্নত সমাজগঠনকারী হয়, তবে সেটি গ্রহণ করা উচিত। আর প্রাচীন ভাবধারা যদি গোঁড়ামি, জীর্ণ মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে, তবে তা বর্জন করা উচিত- এমন চিন্তাধারাতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি জন স্টুয়ার্ট মিলের তর্কশাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগী হন। যুক্তি, বুদ্ধি, তর্ক যে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভীষণ প্রয়োজন তা অনুধাবন করেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। এছাড়া ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ দেশে টিকে থাকতে গেলে  কূটনীতি, আন্তর্জাতিকতাবাদ যে ভীষণ প্রয়োজন সেটাও তিনি অন্বেষণ করেছিলেন। আবার এর পাশাপাশি তিনি সত্যবাদিতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, আর মমত্ববোধের মতন জীবন গঠনকারী শিক্ষার প্রতি ভীষণ অনুরাগী ছিলেন। শিক্ষাকে বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন ও পর্যালোচনা করেছিলেন তিনি।
        আধুনিক শিক্ষার পরিকাঠামোকে এতোগুলো বছর আগেই অঙ্কন করেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। আবার ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞানের মতন বিষয়কেও তিনি নতুনভাবে যুক্ত করেন পাঠ্যসূচিতে। শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন নয়, সর্বোপরি বৌদ্ধিক বিকাশসাধনের জন্যই তিনি প্রায় প্রতিটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এডুকেশনাল কনস্ট্রাটিভিসমের অন্যতম রূপকার ছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল বিদ্যাসাগর মশাইয়ের 'বর্ণপরিচয়'।
        ছোট্ট বয়স থেকেই যাতে শিশুদের মধ্যে দয়া মায়া, মনুষ্যত্ব, শ্রদ্ধা-ভক্তি, স্নেহ ও ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়, তার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছিলেন চরিতমালা, আখ্যানমঞ্জরী আর কথামালা। চরিতমালায় সংকলিত করেছিলেন কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, উইলিয়াম জোন্সের সংক্ষিপ্ত জীবনী। শৈশবকাল থেকেই যাতে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে শিশুরা আবিষ্কার, উদ্ভাবনী শক্তি ও মানবসেবায় বিজ্ঞানের প্রয়োগের রসে সিক্ত হয়, তার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। কথামালা ছিলো নীতিশিক্ষার এক আকর। আবার আখ্যানমঞ্জরীতে তিনি সংকলিত করেছিলেন ইউরোপ ও আমেরিকার সত্যিকারের গল্প এবং জনপ্রিয় গল্প, যেখানে "মাতৃভক্তি", "পিতৃভক্তি", "গুরুভক্তি", "ভ্রাতৃস্নেহ", "আতিথেয়তা", "পরোপকার"-এর মতন বিষয়গুলি ঘন সন্নিবিষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি অন্তরের দৃষ্টিকে, বোধের দৃষ্টিকে, প্রজ্ঞার আলোকরশ্মিকে প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে চালু করেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। ইংরেজি ভাষা যেহেতু আন্তর্জাতিক ভাষা, তাই কর্মক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে এই ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম- এই বিষয়টা অত্যন্ত যত্নসহকারে ভেবে দেখেছিলেন তিনি। অনেক মানুষ এই বিষয়টা নিয়ে সমালোচনা করলেও তিনি অনড় থাকেন তাঁর সিদ্ধান্তে। পরবর্তীকালে অনেকেই বুঝেছেন তিনি কতখানি দূরদর্শী ছিলেন। ব্রিটিশদের আগ্রাসনকে ঘৃণার নজরে দেখলেও সাহেবদের শিক্ষা পরিকাঠামো, প্রগতিশীল পদক্ষেপ ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর মশাই বুঝেছিলেন, দেশের অন্ধ চোরাগলির জরাজীর্ণ প্রথাকে পরাভূত করতে গেলে আধুনিক শিক্ষা পরিকাঠামো তৈরী করতে হবে, যেই কাজটি সহজ হতে পারে সাহেবদের সাহচর্যে। উডের নতুন শিক্ষানীতিকে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রয়োগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। উড চেয়েছিলেন দেশীয় জনগণকে শিক্ষিত করে তাঁদের মুনাফার স্বার্থে ব্যবহার করতে। অপরদিকে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন‌ ব্রিটিশদের এই নীতিকে শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজে ব্যবহার করতে। স্কুল পরিদর্শকের ভূমিকায় থাকার সময় স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকার্যের পাশাপাশি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন ছাত্রবান্ধব পরিবেশের প্রতি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে পাথেয় করে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন মডেল স্কুল গড়ে তুলতে। বৈদেশিক চিন্তাধারা, হাতে কলমে শিক্ষালাভ এবং এর পাশাপাশি প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশের মধ্যে অন্বয়সাধনই ছিলো তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। প্রশ্নপত্রের মধ্যে জ্ঞানমূলক, প্রয়োগমূলক, বোধমূলক প্রশ্নের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ পরীক্ষার সময়ও যাতে ছাত্র ছাত্রীরা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারে, নব আঙ্গিকে ভাবতে পারে, তার চেষ্টা করতেন। আবার তিনি একাধিক বিদ্বজ্জনের সহায়তায় তৈরী করেছিলেন নতুন এক শিক্ষা কমিটি, যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সবার জন্য উন্নত আধুনিক বিশ্বমানের শিক্ষা। যার মূল ভিত্তি তৈরী হবে মানবতা আর যার শিখর হবে নৈতিক শিক্ষা, আর মাঝখানের স্তরগুলোতে থাকবে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বহুকৌণিক জ্ঞান। ছাত্রছাত্রীদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য গণিত আর যুক্তিশাস্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট একটা মজার খেলা চালু করেছিলেন (যেটা বর্তমানে reasoning নামে পরিচিত), আবার বিভিন্ন ধরণের সাইকোলোজিক্যাল টেস্টও নিতেন। অনুসন্ধিৎসু ছেলেদের জন্য গ্রন্থাগার তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য তৈরী করেছিলেন সার্ভে টীম।
এভাবেই আজীবন বিদ্যাসাগর মশাই শিক্ষাকে নিয়ে, শিক্ষার পরিকাঠামো নিয়ে গবেষণা করেছেন। আজ এতগুলো দিন, এতগুলো যুগ পেরিয়ে আসার পরও কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।

তথ্যসূত্র :
১) উইকিপিডিয়া
২) এই সময়
৩) আজকাল
৪) প্রতিদিন(রবিবাসরীয়)

       মৃণাল কান্তি দেব 
© Copyright Protected

Post a Comment

0 Comments

Close Menu