আমার বাবা
কাকলী দেব
ছেলেবেলা
(আমার বাবার ভাল নাম নির্মলেন্দু সেনগুপ্ত। বাবা সেটা নিজে সাবালক হওয়ার পর থেকেই সুবিধার জন্য নির্মল সেন হিসেবেই ব্যবহার করত।) আমাদের পৈতৃক বাড়ী ছিল বহরমপুরে, দাদুদের বাবা বাংলাদেশের ফরিদপুরের বসতবাটী, সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিয়ে স্বাধীনতার অনেক আগেই চলে আসেন এখানে। তার দূরদর্শিতার ফলে তার উত্তরসূরীদের আর দেশভাগ জনিত কষ্ট ভোগ করতে হয়নি।
বাবার যখন ষোলো বছর বয়স, তখন, একদম হঠাৎই বাবার বাবা মানে আমার দাদু মারা যান। এর আগে পর্যন্ত বাবার জীবন ছিল আর পাঁচটা সহজ সাধারন, ছেলের মতই , যে জীবনে ছিল মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার গল্প। উনিশ জন তুতো ভাই বোন মিলে একসাথে বড় হওয়া। বাবার কড়া শাসন, কোমলপ্রানা মায়ের অত্যধিক স্নেহ। ঠাকুমার পাঁচটি সন্তানের মধ্যে প্রথম মেয়ে আর তার থেকে মাত্র দুবছরের ছোট এই ছেলে ছিল সবচেয়ে আদরের।
কিন্ত একরাতের এই হঠাৎ মৃত্যু বাবার জীবন টা আমূল বদলে দিল। কড়া বাবার শাসন ছাপিয়ে যে অপ্রকাশিত স্নেহের ফল্গুধারা বাবার জীবনে বয়ে যেত, তার অভাবে, বাবা হয়ে উঠল ছন্নছাড়া স্বভাবের। কাকা জ্যাঠাদের ভয় পেত ঠিকই, কিন্ত বাবার অভাব, অনুভূত হতে লাগল প্রতিনিয়ত। মাকে লুকিয়ে হাউহাউ কান্না, বড় লাল সিঁদুরের টিপ পড়া মাকে, সাদা শাড়ীতে দেখতে অসহ্য লাগা, ছোট তিন ভাইবোনের শুকনো মুখে বসে থাকা এড়াতে, বাবা ক্রমশ সংসার বিমুখ হয়ে উঠল। প্রিয় দিদির বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ী চলে যাওয়ার পরদিনই বাবার মৃত্যুর আঘাত বোধহয়, আমার বাবা সারাজীবন মনের কোনায় পুষে রেখেছিল।
জীবনের রাজপথে
তখন কার দিনের আই এ পাশ করে বাবা কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে পড়াশোনার থেকে বেশী হল পলিটিক্সে যোগদান। দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বাবা ঝুঁকে পড়ল কমিউনিজম এর দিকে। পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরনার্থী দের দূর্দশা খুব কাছ থেকে দেখতে পেল। দেশের মধ্যেই গরীব মানুষের অসহায়তা বাবার অল্প বয়সী মনকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিল। কমিউনিস্ট পার্টি তখন, যুব সমাজের মধ্যে তার আদর্শ ছড়াচ্ছে। তৎকালীন কংগ্রেসের নেতারা স্বাধীনতার নামে আসলে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই কিন্ত তার সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা, বস্তাপচা সিস্টেমকে রেখে গেছে দেশের নেতাদের মধ্যে।
একজন আদর্শবাদী কমিউনিস্টের সংস্পর্শ, বাবার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। বাবা, আই এ পাশ করে গ্র্যাজুয়েশনের পড়াশোনার পাশাপাশি, পুরোপুরিই যোগ দিল পলিটিক্সে। আদর্শ ছিল সামনে, মানুষের ভালর জন্য কাজ করা।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাবা র সামনে এই আদর্শ উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গিয়েছিল। অনেক দূর্নীতি দেখেছে, অন্য মানুষের হঠকারিতা, চাটুকারিতা বাবাকে অবাক করেছে, এই সবের থেকে চিরকাল দূরে থেকেছে। পলিটিক্যাল কেরিয়ার তৈরীর বহু সুযোগকে তাচ্ছিল্য করে, নিজের আদর্শের জগতেই থেকে গেছে।
ভারতীয় রেলের, চাকরীর প্রায় পুরো মাইনে তুলে দিতো কমিউনিস্ট পার্টির ফান্ডে। প্রচুর পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থেকেছে, বিশেষত শেষ জীবনে। কখনও মনের জোর হারায়নি। খুব সাবলীল আর পজিটিভ মানসিকতার অধিকারী ছিল। সততা আর, পরোপকারিতাই, ছিল শেষ পর্যন্ত জীবনের লক্ষ্য। নিঃস্বার্থ ভাবে বহু মানুষের উপকার করেছে জীবনে। বাবার মৃত্যুর পরে এমন অনেক ঘটনা, উপকৃত মানুষ গুলির কাছ থেকে জানলাম, যা বাবার নিজের মুখে কোনও দিন শুনিনি।
বাবা অজস্র বই কিনেছিল, জ্ঞানলাভের অদম্য পিপাসা ছিল বলে! সেইসব বই আজ হয়তো দূর্লভ! যদি কেউ এসব বই পড়ে অজানাকে জানার আগ্রহ মেটাতে পারে, তাহলে বাবা, যে মানসিকতার অধিকারী ছিল তা সার্থকতা লাভ করবে।
0 Comments