Ad Code

.
.
1 / 6
2 / 6
3 / 6
4 / 6
5 / 6
6 / 6

মহামায়ার মহাজাগতিক বহিঃ প্রকাশ | কুনাল রায় | প্রবন্ধ


দ্যাশক্তি মহামায়া এই রহস্যময় সৃষ্টির জগত জননী। তাঁর আদি নেই অন্তও নেই। আছে শুধু রূপান্তর, এক রূপ থেকে অন্য, অন্য থেকে বহুজন। তাঁর প্রাকৃতিক কোন রূপও নেই। এই বিশ্ব চরা চরের সবকিছুতেই তাঁর  বহিঃ প্রকাশ। যখনই কোনও সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে, তখনই দেবী আবির্ভূতা হয়ে দমন করেছেন ওই দুষ্টের ও স্থাপন করেছেন ধর্মকে।  


    আদ্যাশক্তি মহামায়ার কথা বলতে গিয়ে সব থেকে আগে যেটি মনে পরে সেটি হল একটি সামান্য শব্দ কিন্তু অসামান্য তার তাৎপর্য। শব্দটি হচ্ছে ‘মা’, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি আনন্দ স্রোতের উৎস বোধকরি লুকিয়ে আছে এই শব্দটির মধ্যে। কিন্তু আমাদের এই ‘মা’ কেও কম কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু কেন? কি প্রয়োজনে ? জগৎ মাতা জগৎধাত্রীকেও পরীক্ষা! যোগমায়ার পরীক্ষা এও কি সম্ভব! কারণ সৃষ্টির নিয়মের উর্দ্ধে কেউ নয়। নিয়তির কাছে কোন না কোন সময়, সকলেই নিজেকে সমর্পিত করতে হয়। আমাদের এই ভারতবর্ষে ‘’একান্ন’’ মহাপীঠই মূলত সেই কঠিন পরীক্ষার সাক্ষ্য এখনও বহন করে চলেছে, বৃদ্ধি করছে তাঁর গৌরবময় ইতিহাসকে।   


    পুরাণে উল্লেখিত আছে যে প্রজাপতি দক্ষ, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মদেবের মানসপুত্র জগৎজননী মহাশক্তিকে কন্যারূপে পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জগৎজননী এই প্রস্তাবে কিছুটা হলেও অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে তিনি   প্রজাপতি দক্ষের ঘরে কন্যারূপে জন্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু এই দৈবলীলায় দেবী একটি মাত্র শর্ত ছিল। তা হল, যে মুহূর্তে প্রজাপতি তাঁকে উপেক্ষা করবেন, সেই মুহূর্তে উনি এই পার্থিব শরীর ত্যাগ করে, ব্রহ্মান্ডে মিলিয়ে যাবেন, চিরতরে। 


দক্ষ গৃহে দেবী লালিত পালিত হতে লাগলেন। নামকরণ করলেন স্বয়ং দেবর্ষি নারদ। সতী রূপে দেবীর গুন শত দিকে উদ্ভাসিত হতে লাগল। কিন্তু বিধির বিধান কে লঙ্ঘন করবে! সতী দেবাদিদেবকেই নিজস্ব স্বামী রূপে নির্বাচিত করলেন। রাজ রাজ্যেশ্বরী এক দীনহীন ভিক্ষুক কে নিজের বরমাল্য দান করবেন তাঁর কণ্ঠে, এটি প্রজাপতি কিছুতেই অনুমতি দিলেন না। তবুও সতী অনড় তাঁর সিদ্ধান্তে, যাই হোক সর্ব লক্ষণাযুক্তা দক্ষ কন্যা সতী শিবপ্রিয়া সতীতে পরিণত হলেন।


এই বিবাহের কিছুকাল পরেই নৈমিষারণ্য বিশ্ব স্রষ্টাদের বৃহ যজ্ঞের সূচনা হল। শিব আমন্ত্রিত হলেন। কিন্তু যজ্ঞাগারে প্রজাপতিকে উচিত সম্মান না জানানোয়ে, প্রজাপতি ক্ষিপ্ত হলেন। সকল দেবতাদের সম্মুখে উনি না ভেবেই ও ক্রোধবসত দেবাদিবকে অভিশাপ দিলেন যে এরপর থেকে শিব সকল যজ্ঞ ভাগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন। কিন্তু দেবাদিদেব শঙ্কর মৌন, ধীর স্থির, তিনি যে আশুতোষ! দক্ষের এই অভিশাপে উনি কোন ভাবেই কোনও রকম প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করলেন না। প্রজাপতি সহ সকল দেবগণ যজ্ঞস্থান পরিত্যাগ করলেন। বোধ করি দেবীর ইচ্ছায় বীজ বপন করা হল পরবর্তী এক করুণাময় অধ্যায়ের সাথে মর্তবাসীর কল্যাণও বটে। মহালক্ষীর কেমন লীলা, কেবল মহালক্ষীই জানেন। 


    এর বেশ কিছু কাল পর, দক্ষ এক বৃহৎ বৃহস্পতির যজ্ঞের আয়োজন করেন। সকলে আমন্ত্রিত থাকলেও শিব সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন না। অথচ শিব জায়ার অতীব ইচ্ছা পিতৃালয়ের উনি গমন করেন। দেবর্ষি নারদ তাঁকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সতী দক্ষের দ্বারে উপস্থিত হলেন। প্রশ্ন করলেন তাঁর পিতাকে, যে কেন এমন অবিচার! শিব বিহীন যজ্ঞ তাও কী সম্ভব! দক্ষ তাঁর মহামায়া স্বরূপ কন্যাকে ভৎসনা করলেন। দেবাদিদেব শঙ্করের নামে নিন্দা করলেন। নানা বিশেষণে শঙ্করকে দেব মযার্দা দিতে অস্বীকার করলেন, সতী এই পতি নিন্দা শ্রবণ না করতে পেরে স্বয়ং যোগবলে তৃতীয় নয়ন উন্মোচিত করে নিজেকে আহুতি দিলেন। দক্ষ মহামায়াকে কন্যা রূপে পেয়েও রাখতে পারলেন না, পরম সৌভাগ্য দুর্ভাগ্যে রূপান্তরিত হল, দক্ষের অহংকার ও নির্বোধ আচরণে। 

সংবাদ পৌঁছাল দেবাদিদেবের নিকটে। ক্রোধ, অভিমানে, প্রজাপতি দক্ষের দর্প চূর্ণ করবার ব্রতী হলেন তিনি। নিজের জটার থেকে সৃষ্টি করলেন বীরভদ্র ও অন্যদিকে ভদ্রকালীকে, আদেশ করলেন দক্ষ যজ্ঞের বিনাশ করতে। বীরভদ্র ও ভদ্রকালী দক্ষালয়ে পৌঁছে দক্ষ যজ্ঞ বিনষ্ট করলেন। বীরভদ্র যা মহাকালের অন্যতম রূপ, প্রজাপতির শিরচ্ছেদ করলেন। যজ্ঞপুরী তখন এক শশ্মানপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। 


    দেবাদিদেব শঙ্কর ভোলা মহেশ্বর এরপর পৌঁছালেন দক্ষালয়ে, অশ্রু ধারায় সিক্ত তাঁর দুই নয়ন। তাঁর জায়া সতী আর নেই। উমাপতি একা হয়ে গেলেন। সতীর নিষ্প্রাণ দেহটি কাধে তুলে নিয়ে নৃত্য শুরু করলেন। মনে হতে লাগল এক প্রলয়ের সূচনা ঘটেছে। পৃথিবী, আকাশ, বাতাস তখন নটরাজের এই নৃত্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল। সবকিছু কালের এক অমোঘ নিয়মে বিলুপ্তি পাচ্ছিল। সৃষ্টি রসাতলে যাওয়ার ঠিক প্রাক মুহূর্তে, দেবরাজ ইন্দ্র সহ সকল দেবগণ এবং স্বয়ং ব্রহ্মদেবও উপস্থিত হলেন বৈকুণ্ঠপতি নারায়ণের কাছে। নারায়ণ তখন ক্ষীরোদ সাগরে অনন্ত শয্যায়, পাশে স্বয়ং কমলা বিরাজ করছেন। নারায়ণ দেবতাদের সঙ্কট শ্রবণ করলেন। সৃষ্টির পালন কর্তা তখন মহেশ্বরকে শান্ত করবার প্রয়াস করলেন। নিজের সুদর্শন চক্রের দ্বারা দক্ষ কন্যা সতীর কায়াকে মোট একন্নটি খন্ডে খন্ডিত করলেন। পুরাণমতে যেই যেই স্থানে, মায়ের দেহের অংশ পড়েছিল, সেই সেই স্থানে দুর্গা অথবা কালীর মন্দির স্থাপিত হয়। রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস, এক নতুন অধ্যায়। পরবর্তীকালে যা শক্তি পীঠ রূপে পরিচিতি পায়।


    পীঠ শব্দের অর্থ হল আসন। দেবী যেখানে বিশেষ ভাবে বিরাজিত সেখানেই তাঁর পীঠ। ভারতবর্ষে সাধারণত ভাবে একান্নটি পীঠের কথা বলা হলেও, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সাহিত্য অনুসারে পীঠের সংখ্যা বিভিন্ন রকমের। কুব্জিকাতন্ত্রে পীঠের সংখ্যা ৪২, জ্ঞানার্ণবতন্ত্র ৫০, পীঠ নির্ণয় অনুসারে ৫১, শিবচরিতেও ৫১টি পীঠের সঙ্গে ২৬টি উপপীঠের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে কোনও কোনও গবেষক মনে করেছেন যে সময়ের সাথে মায়ের পীঠের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিটি পীঠস্থানে দেবী স্বতন্ত্র নামে পূজিতা। কেবল তাই নয়, দেবী মাহাত্ম্যের সঙ্গে সঙ্গে ভৈরব মাহাত্ম্যও বর্তমান। শিব ও শক্তি অভিন্ন। তাই প্রতিটি শক্তি পীঠে স্বয়ং শিবও পূজিত হয়। শিব দর্শন ছাড়া শক্তি পীঠ দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।


    এবার আসা যাক বিভিন্ন শক্তি পীঠের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায়। প্রথমেই আসা যাক কামাখ্যা। এই পীঠ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কামাখ্যায় মায়ের যোনিদেশ নিপতিত হয়েছিল বলে একে যোনি পীঠ রূপেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কামাখ্যা অসমে এক উচ্চস্থানে অবস্থিত, মা ভক্তের কামনা পূর্ণ করেন বলেই মায়ের  আরেক নাম কামাখ্যা। 


    জালন্ধর। পাঞ্জাবে অবস্থিত এই পীঠটি প্রথমত চতুষপীঠের একটি। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী দেবীর এখানে একটি স্তন নিপতিত হয়েছিল। এখানে দেবীর নাম ত্রিপুর মালিনী ও ভৈরব হলেন ভীষণ।


    জ্বলামুখী, সতীর দেহের জিহ্বা এখানে নিপতিত হয়েছিল। সতীর পীঠের মধ্যে তৃতীয় পীঠ এটি। অধুনা পাঞ্জাব প্রদেশের কাংড়া জেলার এক প্রাচীন শহর জ্বলামুখী। এখানেই দেবী স্বমহিমায় বিরাজ করছেন।  


    কাশ্মীর, ভূস্বর্গ কাশ্মীরে দেবীর কণ্ঠ নিপতিত হয়েছিল। পীঠ দেবীর নাম মহামায়া ও ভৈরব হলেন ত্রিসন্ধ্যেশ্বর।  

এরপর কাশ্মীরের মতই নানা রহস্যে আবৃত শারদা পীঠ। শারদা শব্দটির অর্থ সরস্বতী। শারদা পীঠ কাশ্মীরেই অবস্থিত। ইতিহাস পুরাণ ও অলৌকিকতায় মিলে মিশে এক হয়ে গেছে এই পীঠস্থান। কাশ্মীর আলোচনার তৃতীয় ভাগে আমরা মহাতীর্থ অমরনাথের কথা বলি। অমরনাথ শিবক্ষেত্র রূপে প্রসিদ্ধ  লাভ করলেও, শক্তি পীঠে আলোচনায় এর উল্লেখ থাকবেই। যেহেতু ঠিক কোন স্থানে দেবীর কণ্ঠ পতিত হয়েছিল জানা নেই, তাই কাশ্মীরে পীঠ সম্বন্ধীয় আলোচনায় অনেক লেখকই শারদা পীঠ, ক্ষীর ভবানী অমরনাথের একত্র আলোচনা করেছন।


    কালীঘাট, দক্ষিণ কলকাতার একটি অতি প্রসিদ্ধ ও পরিচিত স্থান। পুরাণ অনুযায়ী দেবীর ডান পায়ের চারটি আঙ্গুল পড়েছিল। দেবীর নাম কালিকা আর ভৈরব নকুলেশ্বর। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে দেবী এখানে সদা জাগ্রতা ও মনস্কামনা পুর্ণ করে থাকেন। 


    ত্রিপুরেশ্বরী, জগদ্ধাত্রীর এখানে দক্ষিণ চরণ পতিত হয়েছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির। ভৈরব হলেন ত্রিপুরেশ। তবে কবি ভরতচন্দ্রের ‘’অন্নদামঙ্গল’’ অনুযায়ী দেবীর নাম ত্রিপুরা ও ভৈরব হলেন নল।  অন্য দিকে চন্দ্রনাথে দেবীর হস্ত নিপতিত হয়েছিল। এই পীঠ চট্টগ্রামে উপস্থিত। দেবী এখানে ভবানী রূপে ও ভৈরব চন্দ্রশেখর রূপে অবস্থিত আছেন। বৈদ্যনাথ ধামে দেবীর হৃদয় পতিত হয়, ধামটি দেওঘরে অবস্থান করছে। দেবী এখানে জয় দুর্গা রূপে ও মহাদেব বৈদ্যনাথ রূপে বিরাজ করে ভক্তদের সদামঙ্গল করছেন। 


    গঙ্গা ও যমুনা নদীর সঙ্গম স্থলে প্রয়াগ এক মহাতীর্থ ক্ষেত্র। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ, একটি উল্লেযোগ্য মহাপীঠ। প্রয়াগে দেবীর হাতের অঙ্গুলি পড়েছিল। দেবীর নাম ললিতা ও ভৈরব হলেন ভব। 


    জয়ন্তীরা,  শ্রীহট্ট  শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এক অঞ্চল নাম জয়ন্তী বা জয়ন্তীরা। এই মহাপবিত্র স্থানটি দেবী সতীর বাম জঙ্ঘা পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম জয়ন্তী ও ভৈরব হলেন ক্রমদীশ্বর।


    ক্ষীর গ্রাম স্থানটি আমাদের পশ্চিমবঙ্গ জেলায় অবস্থিত। দেবীর দক্ষিণ চরণের আঁঙ্গুষ্ঠ পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম যুগাদ্যা, ভৈরব হলেন  ক্ষীরখণ্ডক।


    বক্রেশ্বর, বীরভূম জেলায় অবস্থিত। এই বীরভূম জেলাতেই বেশ কয়েকটি শক্তি পীঠ রয়েছে। বক্রেশ্বর অন্যতম। পীঠ মাহাত্ম্য অনুযায়ী দেবীর দুই ভ্রূ  মধ্য অংশ এই স্থানে পড়েছিল। এই পীঠের ভৈরব হলেন বক্রনাথ, দেবী মহিষমর্দিনী।


    কেতুগ্রাম, বর্ধমান জেলায় অবস্থিত। এই জেলার কাঠোয়া শহরের কাছে প্রচীন স্থান কেতুগ্রাম। দেবীর বাম বাহু এখানে পতিত হয়। দেবীর নাম বেহুলা ও ভৈরব হলেন ভীরুক। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার তমলুকে দেবীর এক পীঠস্থানের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। শাস্ত্র অনুযায়ী দেবীর বাম পায়ের গোড়ালি এখানে নিপতিত হয়। দেবীর নাম ভীমা, ভৈরব হলেন সর্বানন্দ।


    লালবাগ শহরের কিছু দূরে অবস্থিত কিরীটকোণা। তন্ত্রমতে এই স্থানেই পতিত হয়েছিল দেবীর মাথার শোভা উজ্জ্বল কিরীট বা মুকুট। দেবীর কিরীট পতিত হয়েছিল বলে দেবীর নাম কিরীটেশ্বরী। 


    একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠস্থান শ্রীহট্ট সম্বদ্ধে ভারতচন্দ্র বলেছেন, শ্রীহট্টে দেবীর গ্রীবা পতিত হয়েছিল। পীঠে দেবী হলেন মহালক্ষী, ভৈরব সর্বানন্দ।


    সতী পীঠের আলোচনায় এবার আমরা কৈলাশ ও মানস সরবোরের দিকে দৃষ্টি পাত করব। দেবীর ডান হাত মানসে পতিত হয়েছে। দেবী এখানে দক্ষরাণী নামে পরিচিত ও তাঁর ভৈরব হলেন হর। 


ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র সতীর ডান পায়ের গোড়ালি পতিত হয়েছে। এখানে সাবিত্রী রূপে দেবীর নাম স্থানু আর ভৈরবের নাম অশ্বনাথ। 


    বৃন্দাবন, শ্যাম অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্যামা মিলে মহাকালী, এই দুই দেবদেবী আমাদের মনন জুড়ে রয়েছেন। পবিত্র এই মহাপীঠে দেবীর কেশজাল পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম উমা, ভৈরব হলেন ভূতেশ। আবার অনেক গ্রন্থে দেবীকে কাত্যায়নী নামে পরিচিত করা হয়। সে ক্ষেত্রে ভৈরব হলেন কৃষ্ণনাথ।


    সতীপীঠ পরিক্রমায় আমরা যে কটি পীঠস্থানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তাঁর মধ্যে হিংলাজ অন্যতম। দেবী দেহের প্রথম অংশ হল তাঁর মস্তক বা মাথা, দেবীর ব্রহ্মরন্ধ্র যে স্থানে পড়েছিল সেই পীঠস্থান সর্ব প্রথম পীঠ চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্থানের বেলুচিস্থানে এই পীঠ অবস্থিত। দেবীর নাম কোট্টরী ও ভৈরব হলেন ভীমলোচন। 


    হিন্দুদের এক মহাতীর্থ হল প্রভাস। পশ্চিম ভারতের কাথিয়াবাড় অঞ্চল হল সোমনাথ তীর্থ। সেই সোমনাথ তীর্থকেই প্রভাস তীর্থ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। তন্ত্র অনুযায়ী এই স্থানে দেবীর উদর পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম চন্দ্রভাগা, দেবীর ভৈরব হলেন বক্রতুণ্ড।  


    পশ্চিম পাকিস্থানের পরে এবার আমরা পূর্ব পাকিস্থান আর্থৎ অধুনা বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করব। পাবনা জেলার উত্তরাংশে পবিত্র করতোয়া নদী তীরে ভবনীপুর নামক স্থানে দেবী বিরাজিত। দেবীর গড়ালী এখানে পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম অপল, ভৈরব হলেন বানেশ।


    মাণবেদকের কথা বলতে গিয়ে বলতে হয় যে দেবীর অংশ নিয়ে কিছুটা হলেও এখানে বিতর্ক আছে। মাণ বেদক (পুষ্কর) রাজস্থানে অবস্থিত, তন্ত্র অনুযায়ী দেবীর মণিবন্ধন যা হাতের কব্জি পড়েছিল। দেবীর‍ নাম গায়ত্রী, ভৈরব হলেন সর্বানন্দ।


    তীর্থ পরিক্রমায় একটি জিনিস আমরা লক্ষ করি যে অবন্তীকেও পীঠস্থান রূপে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। অবন্তী দেশের ভৈরব পর্বতে দেবীর ঊর্ধ্ব ওষ্ঠ পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে মহাদেবী রূপে ও শিব নম্র কর্ণ রূপে বিরাজি করছেন।



    *উজ্জয়িনী, কথটির সঙ্গে কালিদাসের মেঘদূতের কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে যায়। এটি এমন এক সতীপীঠ যেখানে দেবীর কনুই বা কূপরি নিপতিত হয়েছিল। দেবীর নাম মঙ্গলচণ্ডিকা। ভৈরব হলেন কপিলাম্বর।


এলাহাবাদের প্রায়াগ তীর্থকে ছাড়িয়ে আমরা আবার এক মহাতীর্থের দিকে গমন করব, নাম বারানসি। এখানে দেবীর কুণ্ডল পতিত হয়, যে স্থানে এটি পড়ে সেই স্থান মণিকর্ণিকা নামে খ্যাত। সতী পীঠের দেবী হলেন বিশালাক্ষী ও ভৈরব হলেন কাল।


    একান্ন পীঠের মধ্যে যে পীঠগুলির স্থান একেবারেই অসম্ভব তাঁদের মধ্যে কন্যাশ্রম অন্যতম। দেবীর পৃষ্ঠ দেশ পতিত হয়েছিল এখানে। ভৈরবের নাম নিমিষ, দেবী হলেন সমনী। মূলত এটি একটি তীর্থস্থান।


    এই দেবী পরিক্রমায় এবার আমরা নজর রাখব নেপালের দিকে। আমরা নেপালের সতী পীঠ হিসেবে শিব তীর্থ মুক্তিনাথের  কথা বললেও বাস্তবিক পক্ষে এই তীর্থ গণ্ডকীতে। এখানে সতীর গণ্ডদেশ পতিত হয়েছিল। দেবী হলেন গণ্ডকী চণ্ডী ভৈরব হলেন নোপানি। পীঠ নির্ণয় তন্ত্রের মতে একাদশ পীঠ হল গণ্ডকী।


    এবার আমরা বাগমতী নদীর তীরে পশুপতিনাথের দিকে যাত্রা করব। পশুপতিনাথ শিবতীর্থ স্থান, কিন্তু এখানেই রয়েছে গুপ্ত সতী পীঠ। তন্ত্র মতে এখানে দেবীর জানু পতিত হয়েছিল। পীঠ দেবীর নাম মহামায়া, ভৈরব হলেন কপালী।


    বিরজাক্ষেত্র (উৎকল)। উৎকল হল পুরীতে, জগন্নাথ ক্ষেত্র, এখানে দেবীর নাভি পড়েছিল। দেবীর নাম বিমলা, ভৈরব হলেন জগন্নাথ।


    কাললমাধব নামক এই মহাপীঠ ওড়িশায়। গৌরীতন্ত্র অনুযায়ী আমরা তা জানতে পারি। এখানে দেবীর নিতম্ব পতিত হয়েছিল। দেবী হলেন মহাকালী ও ভৈরব অসিতাঙ্গ। 


    পশ্চিমবঙ্গের আরেকটি পীঠ হল ত্রিস্রোতা। পীঠ নির্ণয় অনুসারে ষোল নম্বর মহাপীঠ। দেবীর এখানে বা পা নিপতিত হয়েছিল। দেবী হলেন ভ্রামরী, ভৈরব হলেন ঈশ্বর। 


    সতীপীঠ আলচনায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বীরভূম জেলার একটি বিশেষত্ব আছে। বীরভূমের একটি স্থানের নাম হচ্ছে নলহাটি। নলহাটিতে দেবীর নলা পতিত হয়েছিল। নলা শব্দের অর্থ কনুইয়ের নিম্নভাগ। দেবীর নাম কালিকা আর ভৈরব হলেন যোগীন। 


    সতী পীঠের অন্যতম নাম হল নর্মদা। এখানে দেবীর নিতম্ব পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে নর্মদা ও ভৈরব হলেন ভদ্রসেন।


    শ্রীপর্বত হল, সতী পীঠের আরেকটি নাম, তন্ত্র অনুযায়ী শ্রীপর্বতে দেবীর গুলফ পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম শ্রীসুন্দরী, ভৈরবের নাম সুন্দরানন্দ। মূলত তিরুমালয় কে শ্রীপর্বত বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।


    জনস্থানে, দেবীর চিবুক পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম ভ্রামরী, ভৈরব বিকৃতাক্ষো। অনেকের মতে গোদাবরী উপত্যকায় নাসিক অঞ্চলে, বোম্বাই  প্রেসিডেন্সিতে এই তীর্থস্থান।  


    পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে দ্বাচত্বারিংশৎ  শক্তি পীঠ হল রত্নাবলী, এই স্থানে দেবীর ডানস্কন্ধ পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম শিবা আর ভৈরবের নাম কুমার। এটি পশ্চিমবঙ্গে উপস্থিত।


    অন্য দিকে গোদাবরী তীরে দেবীর গণ্ড পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম বিশ্বেশী, ভৈরব হলেন দণ্ডপাণি। অন্ধ্র প্রদেশের রাজমহেন্দ্রী জেলায় এই সতীপীঠ অবস্থিত।


    রাজর্ষি জনকের রাজপুরী মিথিলা, আমাদের সতীপীঠের একটি পীঠ। মিথিলায় দেবীর বামস্কন্ধ পতিত হয়েছে। দেবীর নাম উমা, ভৈরব হলেন মহাদেব।


    কলকাতার সতী পীঠ কালীঘাট ছাড়াও, আরেকটি কালীঘাট আছে যার অবস্থান বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে জুরানপুর গ্রামে। দেবীর এখানে মুণ্ড পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম জয় দুর্গা আর ভৈরব হলেন ক্রোধীশ। 


পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে আরেকটি শক্তিপীঠ হল নন্দিপুর। এখানে দেবীর গলার পতিত হয়েছিল, দেবীর নাম বন্দিনী, ভৈরবের নাম নন্দিকেশ্বর। বীরভূমের সাঁইথিয়া হল নন্দিপুর। 


    রাবণ রাজার সোনার লঙ্কায় পতিত হয়েছে দেবীর নূপুর। দেবী সেখানে ইন্দ্রাক্ষী ও ভৈরব হলেন রাক্ষসেশ্বর ।

তন্ত্র মতে যশোরে দেবীর পানিপদ্ম পতিত হয়েছে। দেবীর নাম যশোরেশ্বরী, ভৈরব হলেন চণ্ড। অধুনা বাংলাদেশের মধ্যে এই পীঠ পড়েছে। 


    পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুসারে বিরাট দেশে দেবীর পদাঙ্গুলি পতিত হয়। দেবীর নাম অম্বিকা, ভৈরব হলেন অমৃতাক্ষ। যদিও উত্তরবঙ্গে এই পীঠস্থান অবস্থিত কিন্তু ঠিক কোন স্থানে এটি অবস্থিত তা এখনও পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারা যায়নি। 


    এবার আমরা সতী পীঠের অন্যতম পীঠ সুগন্ধাতে আসব। এই স্থানে দেবীর নাসিকা পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম সুনন্দা, ভৈরব হলেন ত্র্যম্বক । এই পীঠ স্থানটি ভারত বিভাগের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে মধ্যে পড়েছে।


    হরিদ্বারের কাছে পঞ্চকুণ্ড অবস্থিত, তাঁর থেকেই পঞ্চসাগর নামটি আসে। দেবীর এখানে অধদন্ত পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম করাহী, ভৈরব মহারুদ্র।


    পীঠ নির্ণয় তন্ত্রের মতে অন্যতম হল শুচিদেশ। শুচিদেশে দেবীর উপরের পাটির দাত পতিত হয়েছে, দেবীর নাম নারায়ণী, ভৈরবের নাম সংহার। শুচিদেশ ঠিক কোথায় অবস্থিত তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে এর স্থান বঙ্গদেশে আমরা ধরে নিতে পারি।


    শর্করা বা করবীর ঠিক কোথায় অবস্থিত তা এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে দেবীর ত্রিনয়ন এখানে পতিত হয়েছিল। দেবী হলেন  মহিষমর্দিনী ও ভৈরব হলেন ক্রোধীশ, তবে গবেষকদের মতে এই ক্ষেত্রটি বর্তমানে পাঞ্জাবে অবস্থিত, যদিও কালিকাপুরাণে এর একটি ভিন্ন নিদর্শন খুজে পাওয়া যায়। 


    জ্ঞানেন্দ্রতনাথ  মোহনের সতীপীঠ বর্ণনায় রামগিরির কথা উল্লেখ করা আছে। এখানে দেবীর স্তন পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম শিবানী, ভৈরব হলেন চণ্ড। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সরকারের মতে রামগিরি মধ্যপ্রদেশের নাগপুরের কাছে রামটেক হল প্রাচীন রামগিরি।


    পীঠ পরিক্রমায় আমরা এবার পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় দেশ পরিক্রমা করব। শক্তিভূমি রাঢ়, অর্থাৎ বর্তমানে যা বর্ধমান রূপে চিহ্নিত। পীঠ নির্ণয় অনুযায়ী অট্টহাস হল একটি মহাপীঠ। এখানে দেবীর ওষ্ঠ  বা  ঠোট পতিত হেয়েছিল। দেবী হলেন ফুল্লরা, ভৈরব হলেন বিশ্বেশো। দেবী ভক্তের সব অভীষ্ট প্রদান করেন। 


    এই অট্টহাসের পর আমরা রাঢ় অঞ্চলের আরেকটি সতী পীঠের কাহিনী আলোচনা করব, যার নাম কাঞ্চী। এখানে দেবীর কঙ্কাল পতিত হয়। দেবীর নাম দেব গভা ও ভৈরবের নাম রুরু।


    একান্ন এই মহাপীঠ ছাড়াও আমাদের এই প্রদেশে বেশ কিছু প্রসিদ্ধ উপপীঠ আছে। শিবচরিতে মোট ছাব্বিশটি উপপীঠের উল্লেখ আছে। এক কথায় বলা যেতে পারে সতী পীঠ পরিক্রমার পথে যথাযথ আধারে ভরা।


    দেবী মহামায়ার লীলা বোঝা সত্যিই অত সহজ নয়। একদিকে যেমন তিনি নিজের আহুতি দিলেন তেমনি অন্য দিকে ভক্তের জন্য নেমে এলেন এই ধরা ধামে, সতীপীঠ পরিচয়ের মাধ্যমে। এই সতী পীঠ আলোচনায় একটি জিনিসই বারবার উঠে এসেছে, তা হল শিবও শক্তির মিলনই সৃষ্টির মূল রহস্য। দেবী যেখানে ভৈরবও সেখানে। অন্তত কাল যুগ ধরে এই সতী পীঠের মহিমা প্রচারিত হয়ে চলেছে। প্রতি বছর ভক্তের ভীড় উপচে পড়ে বিভিন্ন পীঠ স্থানে, প্রমাণিত হয় বারংবার যে ‘’বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর’’।  



কুণাল রায়

সহ অধ্যাপক, ইংরাজী বিভাগ

জর্জ কলেজ, কলকাতা। 







Post a Comment

0 Comments

Close Menu