Ad Code

.
.
1 / 8
2 / 8
3 / 8
4 / 8
5 / 8
6 / 8
7 / 8
8 / 8

" হঠাৎ দেখা " - মনোজ রায় | সম্পূর্ণ গল্প



— এতো বছর পরেও তুই শুধরালি না, কথায় কথায় রাগ করার স্বভাবটা এখনো রয়ে গেছে তোর। 
— হুমম কিছু কিছু স্বভাব এতো সহজে যায় নাকি? 
— মা হয়ে গেছিস তুই, এখনো সেইরকম আছিস। 
— একদম। তুই কেমন আছিস? 
— যা আছি এই তোর চোখের সামনেই। 

            আজ প্রায় সাত-আট বছর পর হঠাৎ দিল্লী এয়ারপোর্টে আদৃজা আর আদিলের দেখা। একে অপরকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে বসে আছে। তাদের পুনরায় যে দেখা হবে সেটা কখনোই কল্পনা করেনি তারা। অবশ্য এভাবে অবাক হওয়ার কারণও আছে। গত ৮ বছর দুজনে আলাদা জীবন কাটালেও ৮ বছর আগে একে অপরকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারতো না তারা। একে অপরকে খুব ভালো বাসতো যে। বিয়েও করতে চেয়েছিলো তারা। সবকিছু ঠিক ও হয়ে যায়। কিনতু একটি সম্পর্ক তৈরী করাটা যতটা সহজ, সেটা সামলে চলাটা ততটাই কঠিন। 

              সেদিনটা ছিল আদৃজা এবং আদিলের বিয়ের ঠিক আগের দিন। দুজনেই খুব খুশি ছিল, আদৃজা হাতের মেহেন্দির দিকে বারবার তাকাচ্ছিলো আর মনে মনে হাসছিল। আর কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপর একে অপরের কাছে আসতে আর কোনো বাধা থাকবে না দুজনের। আদৃজা নিজের হাতের মেহেন্দিটা দেখাবে বলে কল করল আদিলকে। কিন্তু এতো রাতে আদিলের ফোন ব্যাস্ত? কোথায় ব্যাস্ত আদিল? টানা ১৫ মিনিট আদৃজার কল ওয়েটিং থাকার পরও আদিলের কোনো উত্তর নেই। এসব ভাবতে ভাবতে আদৃজার মনে একটা সন্দেহের কাঁটা বিঁধতে লাগল। সাথে সাথে রাগটাও বাড়তে শুরু করে। ৩০ মিনিট ব্যাস্ত থাকার পর আদিল কলব্যাক করলো। 

—হ্যালো.. 
—হ্যালো মানে!! কোথায় ব্যস্ত ছিলিস এতো রাতে? কার সাথে ব্যস্ত ছিলিস? 

প্রচন্ড রেগে গিয়ে একটানা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলো আদৃজা। প্রশ্নগুলো শুনছে ঠিকই কিন্তু উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না আদিল। আর যখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ আসলো তখন আর সেটা আদৃজার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হল না। 

— "আগে থেকেই তোর উপর সন্দেহ ছিল। এখন আমি নিশ্চিত, তাই আমাদের বিয়ে ভুলে যা। যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকিস তাহলে বাড়িতে বলে দিস যে এই বিয়ে করছিস না। যদি আসিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি।" 

শেষ কথাটা বলেই কলটা কেটে দিয়েছিলো আদৃজা। এরকম একটা ছোট্ট কথার জন্য সম্পর্ক নষ্ট? এটা সম্ভব? আদিল জানে আদৃজা কথায় কথায় খুব রেগে যায়। কিন্তু সেই রাগের জন্য কী বিয়ে ভাঙা যায়? আদিল বুঝতে পারলো না কি করবে। অনেকবার কল করার চেষ্টা করল আদৃজাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওর কলটা কেটে দিচ্ছিল আদৃজা। এরকম কিছুক্ষণ চলার পর একটি মেসেজ এলো, অদৃজার। তাতে লেখা ছিল, "আর কোনোদিন যোগাযোগ করবিনা, তাহলে আমাকে আর কেউই দেখতে পাবে না কোনোদিনও।" 

           এরপর আদিলের আর সাহস হলো না আদৃজাকে যোগাযোগ করার। কারণ সে জানতো আদৃজা সেটা করে যেটা সে বলে। কিনতু এত সহজে তাদের সম্পর্কের ভাঙ্গন মেনে নিতে পারলো না আদিল। যদি আদৃজা একবার শুনতো ওর কথা, যদি আদৃজা একবার ওকে বিশ্বাস করত যে বিয়ের আগের রাতে নেহাতই ওর কিছু বন্ধুদের সাথে হাসি-মজা করছিল... এরকম অনেক যদি-র নিচে চাপা পড়ে গেছিল ওর মনের কান্না। কিনতু সেই মুহূর্তে সুইসাইডের হুমকি দেওয়া একগুঁয়ে আদৃজার থেকে দূরে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আদিলের কাছে। এরপর আদিল পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, আর থাকতে চায়নি এখানে। পুরোনো স্মৃতি ভুলতে কিছুদিনের মধ্যেই রওনা হলো আমেরিকা। আদিল আগেই ওখানে জব অফার পেয়েছিলো। কথা ছিলো বিয়ের পর আদৃজাকে নিয়েই বিদেশ পাড়ি দেবে, কিনতু তখন আদৃজাকে ভুলে থাকতে দেশ ছেড়েছিল। 

একটা বাচ্চার আওয়াজে চমক ভাঙল আদিলের। জিজ্ঞাসা করল, "কোথা থেকে ফিরছিস?" 

— আমি তো দিল্লি থেকেই কলকাতা যাচ্ছি। তুই ? 
— যেখানে গিয়েছিলাম সব ছেড়ে সেখান থেকে ফিরছি, আমেরিকা থেকে। আজ ৮ বছর পর। দিল্লিতে নেমে আবার কলকাতার ফ্লাইট। কিন্তু এই পুচকেটা কে? 
— আমার ছেলে দুদিন পর ওর জন্মদিন, তাই কলকাতা ফিরছি। 
— তার মানে তুই দিল্লীতেই থাকিস? তা তোর হাজব্যান্ড কোথায়? 
আদৃজা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। 
— কী হলো? চুপ করে গেলি যে!! 

আদৃজা তবু চুপ করেই রইল। শুধু আদিল দেখল আদৃজার চোখের কোণ বেয়ে জল পড়তে লাগল। তারপর খেয়াল করলো আদৃজার হাতে শাখা-নোয়া বা মাথায় সিঁদুর নেই। 

"মানে ........" কিছু বলতেই যাচ্ছিল আদিল। হঠাৎ ওকে থামিয়ে আদৃজা বলে উঠল, 

— আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর তুই চলে যাস। তার কিছুদিন পর আমি খুঁজেছিলাম তোকে কিন্তু ততদিনে তুই চলে গেছিস। কোথায় গেছিস তোর বাড়ির কেউ বলেনি আমাকে। তারপর বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দেয় দিল্লির একজন ব্যাবসায়ীর সাথে। বছর দুই আগে একটি কার একসিডেন্টে মারা যায় আমার হাজব্যান্ড। তারপর থেকে ব্যবসা, সংসার,ছেলে সব আমাকেই সামলাতে হয়। 

— আমার আদৃজার ওপর দিয়ে যে এত ঝড় বয়ে গেছে সেটা ভাবতেও পারছি না। যেমন সেদিন ওরকম একটা ছোট্ট কারণে আমাদের সম্পর্কটাকে ভেঙে ফেলবি সেটাও কখনো কল্পনা করিনি। সেদিন আমি ফোনে ব্যাস্ত ছিলাম ঠিকই, কিনতু আমার এক বন্ধু নিজেদের মধ্যে সামান্য ঝগড়া নিয়ে সুসাইড করতে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ওকে বোঝানোটাই সবচেয়ে বেশি গুরুতূপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল আমার। তখন মনে মনে নিজেকে খুব লাকি মনে হচ্ছিল আমার, যে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হলেও আমরা মানিয়ে নিতে পারি। কারণ আমার কাছে তুই আছিস। কিন্তু তুই তো আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলি না। একবার ভাবলিও না যে এভাবে সম্পর্ক ভাঙ্গলে আমার কী হবে। 

— তোকে বলার সুযোগ দিলেও সম্পর্কটা আমাদের ভাঙতোই রে। আর তখন যে আমি নিজেকে.... 

— মানে ? 

"প্লিজ গিভ ইওর কাইন্ড অ্যাটেনশন, ফ্লাইট উইল ল্যান্ড উইদিন ফাইভ মিনিটস, কাইন্ডলি চেক ইওর সিটবেল্ট" 

— মনে, আমার নাম আদৃজা মুখার্জী আর তোর নাম মোহাম্মদ আদিল শেখ। আমার বাড়িতে একটানা অস্বীকার করার পর হঠাৎ আমাদের সম্পর্কটা সবাই মেনে নিয়েছিল ভালোভাবেই। তাতে একটু অবাক হয়েছিলাম প্রথমে কিন্তু পরে ভেবেছিলাম সত্যিই মেনে নিয়েছে। তখন তো বুঝিনি তোকে মেনে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল তোকে খুন করা আর তোর নামে মিথ্যে বদনাম দিয়ে আমার মন থেকে তোকে সরিয়ে ফেলা। 

আদিল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে আদৃজার দিকে। আদৃজা বলে চলেছে, "সেদিন হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে খুব খুশি ছিলাম আমি। দৌড়ে ছাদে যাচ্ছিলাম তোকে মেহেন্দির ছবি দেখাবো বলে। হঠাৎ বাবার ঘর থেকে কয়েকজনের চাপা কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোনো প্রবলেম হয়েছে ভেবে ঘরে ঢুকতে গিয়ে বুঝলাম দরজা বন্ধ। তখনই সব শুনেছিলাম। তখনই তোকে কল করছিলাম। কিনতু তুই ব্যস্ত ছিলিস। আর সেই সুযোগটাকেই আমি কাজে লাগালাম। কারণ সত্যি কথা বললেও হয়ত তুই আমাকেবিয়ে করতে চলেই আসতিস। ভেবেছিলাম কিছুদিন পর বাড়ি থেকে লুকিয়ে তোর কাছে যাব। কিনতু ততদিনে তো তুই চলে গেছিস। 

          আদিল তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। সেদিনের পর থেকে ও আদৃজার ওপর কত রাগ করেছে, বিরক্ত হয়েছে। শেষের দিকে নিজের সমস্ত দুঃখের জন্য আদৃজাকেই দায়ী করেছে আর ওকে অ্যাভয়েড করে ভুলতে চেয়েছে। আজকে দুজনের দেখা হওয়ার একটু আগে অবধি আদিল ভাবত আদৃজা ওর লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। কিনতু আদৃজা তো ওকে পুরো জীবনটাই দান করে গেল। এতদিন ও শুধু নিজের পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব কষত। কিনতু আজ জানলো আদৃজা পুরোটাই ওকে দিয়ে গেছে, বদলে চায়নি কিছুই। 

— এক্সকিউজ মি স্যার ...ফ্লাইট ল্যান্ড করে গেছে। 

এয়ার হোস্টেসের ডাক শুনে ঘোর কাটল আদিলের। দেখলো পাশে আদৃজা নেই... সবাই বেরিয়ে গেছে। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ডাকল, "আদৃজাআআ....!!!" আদৃজা ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো আদিলকে। আদিলও দূর থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। এখন আর ওর মনে কোনো খারাপ লাগা নেই। কারণ ও জানে আদৃজাকে জীবনে না পেলেও আদৃজার অদৃশ্য ভালোবাসা ওকে আজও আগলে রেখেছে।


                                                ©  মনোজ রায় ©

Post a Comment

0 Comments

Close Menu