মাস খানেক অতিক্রম হওয়ার পর আমাদের গানের টিমের যিনি হেড তিনি বারে বারে ফোন করছেন গান গাইতে যাওয়ার জন্য। আজ যাবো কাল যাবো এই ভাবে বলেও যখন যাচ্ছি না তখন একদিন টিমের হেড রজতাভদা আমার বাড়িতে এলেন। বললেন - "কি ব্যাপার বলতো, "আসছো না কেন? টাকায় পোষাচ্ছে না?"
আমি বললাম - "ছিঃ ছিঃ তা নয়। ব্যাপারটা হলো ছেলে। এই দুরন্ত ছেলেকে কার কাছে রেখে যাবো? তাই...."
শুনে বললেন - "তুমি ছেলেকে নিয়ে চলে এসো,
আমরা সকলে মিলে ম্যানেজ করে নেবো।"
এই ভাবে রির্হাসেল ও স্টেজ চালাচ্ছি। বড় কষ্ট,
আর সম্ভব হচ্ছে না। বছর খানেকের ছেলে, এই খিদে পাচ্ছে তো এই পায়খানা পাচ্ছে, তো এই পেচ্ছাব পাচ্ছে। আমাদের টিমের আরো
দুটো মেয়ে গান করে। আমি যখন গান করি তখন ওরা সায়ন্তনকে সামাল দেয়। কষ্ট হলেও এভাবেই চলছিলো।
এমতাবস্থায় সেই সুযোগসন্ধানি মানুষটা, আমার পতিদেব, একদিন এলেন সকাল দশটা নাগাদ। এই সময় আমার সব কাজ হয়ে যায়। কারণ সায়ন্তন ঘুম থেকে ওঠার আগেই সব কাজ সেরে নিই। সায়ন্তন সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু খেলে, তারপর সেরেল্যাক গুলে খাইয়ে দিই, আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এই ঘুম মোটামুটি দশটা পর্যন্ত চলে। এই সময়ের মধ্যে সংসারের সব কাজ, রান্না, কাচাকাচি, ঘর-দোর পরিস্কার, স্নান- সব সেরে নিই। যদি জেগে যায় তাহলে সব কাজ হলেও স্নান সারা হবে না। তারপর এখন হাঁটতে শিখেছে। যেখানে যা পাচ্ছে টেনে এনে ছড়িয়ে লন্ডভন্ড করছে নতুবা মুখে পুরছে। সায়ন্তনকে কোলে নিয়ে খেলছি, সেই সময়
উনি এলেন।
-- "সায়ন্তনবাবু তুমি কেমন আছো? মায়ের কোলে খেলা করছো। এসো তো বাবা আমার কাছে, আমি খেলি তোমার সাথে। কি গো কেমন আছো?" বলতে বলতে ধপ করে মেঝেতে বসে সায়ন্তনের সাথে খেলা শুরু করে দিলো।
তারপর দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলো। আমাকে প্রস্তাব দিলো, "তুমি গান গাইবে, আমি বাড়িতে ছেলেকে পাহারা দেবো। আমার তো একটা হাত খরচ আছে। যেদিন স্টেজ থাকবে আমাকে পাঁচশো টাকা করে দিতে হবে।" আমি বললাম ভেবে দেখবো। রাত্রে থাকার ফন্দি আঁটছিল, কোনরকমে তাড়ালাম।
দুদিন পর আবার এলো। নির্লজ্জের মতো বললো - "দেখো পুরুষের রোজগারে স্ত্রীরা
খায়, আমি না হয় স্ত্রীর রোজগারে খাবো। বাড়ির সব কাজ আমার, এমনকি রান্নাবান্না পর্যন্ত।"
কি ছোটলোক! তবুও কাজ করবে না, রোজগার করবেনা। আমি নিম তেতো মুখে রাজি হলাম।
আমার স্টেজ প্রায় দিনই থাকে। ছেলেকে
অরিত্রর কাছে রেখে গেলেও দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। কিন্তু করার কিছু নেই। এ ভাবেই চলল দিন দশ-পনেরো। একদিন অরিত্র বললো, "আমি একটা স্টেজ ধরেছি, ওখানে মিউজিশিয়ানরা আছে, কেবল গায়িকা দরকার। তুমি গাইবে? পার স্টেজ দশ হাজার।"
এখন দু হাজার পাই, দশ হাজার পেলে কার না লোভ হয়। বললাম - "দশহাজার যদি পাই গাইতে রাজি।"
আমাকে নিয়ে গেল সন্ধ্যার সময় একটা হোটেলে। আমাদের একটা রুম দিলো থাকতে। বুঝতে পারলাম বারে গান গাইতে হবে। অরিত্র সায়ন্তনকে নিয়ে রুমে থাকলো, আমি গান গাইতে গেলাম। মিউজিশিয়ানরা বললেন - "দিদি কি গান গাইবেন?" আমি গানও স্কেল বলে দিলাম। গান শুরু হতেই যত মাতাল নাচতে শুরু করলো। কিছু জনতা সব জায়গায় থাকে যারা মদ খেয়ে মাতলামি করতে আসে, কিন্তু তারা কখনোই স্টেজে উঠে আসে না।দূর থেকেই নোংরা কটূক্তি ছুড়ে দেয়। সে সব গা সোওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে অন্য রকম। সবাই ছুঁতে চায়, নাইট কন্ট্রাক্ট করতে চায়। কোনো রকমে সবার ছোঁয়া বাঁচিয়ে খান পাঁচেক গান গেয়ে চলে এলাম রুমে। এসে অরিত্রকে জিজ্ঞাসা করলাম - "পেমেন্ট নিয়েছো?"
আমার চোখ মুখ দেখে সমূহ বিপদের আঁচ পেয়ে বললো -হ্যাঁ।
-- দেখাও। দেখাতে বললাম এই কারনে যে এই
জানোয়ার টাকে একদম বিশ্বাস করি না। যে
টাকার জন্য নিজের স্ত্রীকে বারে নাচাতে নিয়ে
আসতে পারে, এমনকি নাইট কন্ট্রাক্টেও ছেড়ে দিতে দুবার ভাবে না, তাকে বিশ্বাস করি কি করে? এর মধ্যে এক বোতল মদ খাওয়া হয়ে গেছে।
-- আছে তো।
-- দেখাও। চিৎকার করে বললাম।
অরিত্র ভয়ে ভয়ে পকেট থেকে পাঁচটি দু'হাজার টাকার নোট বার করে দেখালো। আমি ছৌঁ মেরে টাকাটা নিয়ে অরিত্রকে দু'হাজার দিয়ে আট হাজার নিয়ে সায়ন্তনকে কোলে নিয়ে বললাম - চলো।
হোটেলের ম্যানেজার আবার কবে আসবো
জানতে চাইলেন। জানালেন আমার গান সবার খুব ভালো লেগেছে। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম - "পরে জানাবো।"
বাড়িতে এসে অরিত্রকে বেদম ঝাড়লাম কেবল
মারতে বাকি রেখে ছিলাম।
সংস্কার করাবো কি করে, বাড়ি তো আমার একার নয়, আরো দুজন ভাগিদার আছে। তাই বোনেদের ও ওদের বরেদের সাথে এ বিষয়ে কথা বললাম। বোনেদের বরেরা বলল - "দিদি আমরা দেখলাম সত্যিই বাড়িটির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক আছে দিদি, তোমাকে কিছু করতে হবে না, আমরা সব কিছু সারিয়ে টিপটপ করে দেবো।"
আমি বললাম - "কত টাকা খরচ হবে?"
মানিক বললো - "সে দেখা যাবে।"
-- না খুব বেশি খরচ হলে তো পারবো না। তোমরা তো আমার ব্যাপারে সব জানো, তাই বলছিলাম।"
সনাতন বললো - "তাই বলছিলাম মানে? তুমি কি মনে করছো তোমার কাছে টাকা নিয়ে বাড়ি সারাবো?"
-- আমি বাড়িতে থাকবো আর বাড়ি সারাবে তোমরা, এটা কি হয়? একেই তো বাড়ি দখল করে আছি?
মানিক বললো - "বাড়ি দখল করে আছি মানেটা কী? তুমি আমাদের দিদি নও! আমরা আমাদের দিদিকে বাড়ির থেকে উচ্ছেদ করে আমরা বাড়ির দখল নেবো! এটা তুমি ভাবতে পারলে দিদি? "
অনেক মান অভিমান, অনেক কথাবার্তার পর ঠিক হলো বাড়িটি প্রমোটারকে দিয়ে দেওয়া হবে। কিছু দিনের মধ্যেই দাম দর ঠিক করা হলো। মনের মতো দাম পাওয়া গেল। প্রমোটারের সাথে কথা হলো এখুনি ঘর ছাড়তে হলে এই এলাকার মধ্যে একটা ফ্ল্যাট দিতে হবে। এখন ভাড়া দিয়ে থাকবো। পরে
এই ফ্ল্যাট তৈরী হয়ে গেলে তিনটি রুমের দক্ষিণ পূর্ব খোলা দোতলায় একটি ফ্লাট দিতে হবে। না আমি কোন সুযোগ নিতে চাইনা। ঐ ফ্ল্যাট আপনাকে বিনামূল্যে দিতে হবে না। দেখবেন যেন আমার সাধ্যে কুলোয়।
বোনেরা বললো - "দিদি তুই কি আমাদের থেকে কানাকড়িও নিবি না?"
-- কানা কড়ি নিয়ে কি করবো! যার দুটো এত ভাল বোন, এত ভালো দুটো ভাই তার আর কী দরকার?
যাই হোক কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে ফ্ল্যাট দিলো, আমি যেখানে রির্হাসেল করি তার থেকে সামান্য দূরে। ফ্ল্যাটে চলে গেলাম। ফ্ল্যাটটি সাজাতে বেশ খরচ হয়ে গেল। তারপর সামনের বছর ঐ ফ্ল্যাটটি দেবে। তাতে যে টাকা পাচ্ছি তাতে হবে না তাই টাকা চাই। জোর কদমে শো করছি। মনপ্রাণ ঢেলে গান গাইছি। আমার এখন শূন্য হাত বরং ফ্ল্যাটটি সাজাতে ধার হয়ে গেছে। সেই ধার শোধ করে কি করে টাকা জমাবো তার জন্য এতো পরিশ্রম। এদিকে অরিত্রকে শো থাকলেই পাঁচশো করে দিতে হয় প্রতিদিন। বাজারে ধার, হাতে টাকা নেই, তাতেও অরিত্রর কোন মাথাব্যথা নেই। পার শো পাঁচশো চাই। খায় আমার টাকায় তবুও পাঁচশো টাকায় হাত খরচ কুলোচ্ছে না। এদিকে ছেলের স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে ওকে অরিত্র ঠিক করে দেখে তো! সারা দিনরাতের বেশির ভাগ সময়টাই ছেলে অরিত্রর কাছে থাকে। আমি বাড়ি ফিরলে ছেলে খাবার জন্য হা হা করে। কী করে খবর নেবো? ফ্ল্যাটে কাউকে বলে যাবো সে উপায়ও নেই। তেমন ঘনিষ্ঠতা কারো সাথেই গড়ে ওঠেনি। তাই একদিন অরিত্রকেই জিজ্ঞাসা করলাম - "আমি বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই সায়ন্তন খাবার জন্য হা হা করে। আমি যে খাবার রেখে যাই সে খাবার ওকে খাওয়াও না নাকি?"
অরিত্র হেসে বলে - "শোন কথা! মাকে দেখলে ছেলে দুধ খেতে চাইবে না? সারা দিনে রাতে তোমাকে কতটুকু পায় বলো?"
বুঝলাম এই অভিনেতার কাছ থেকে সত্যিটা
কিছুতেই জানা যাবে না।
একদিন সুযোগ এসে গেল। আমাদের স্টেজ শো ক্যানশেল হয়ে গেল। আমি ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। দরজা খুলতেই দেখি ছ'খানা বন্ধু নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে অরিত্র। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো, তারপরেই
অভিনয় শুরু করে দিলো। আমি অরিত্রকে
থামিয়ে ওর মাতাল বন্ধুদের বললাম - "দাদাভাইরা আপনার আসুন।" কিছুতেই যেতে চায় না। শেষে পুলিশের ভয় দেখাতে গেল। ওরা যেতেই বললাম - "সায়ন্তন কোথায়?"
-- ঘুমোচ্ছে।
-- এই সময় তো ঘুমায় না, দেখি।
দেখলাম ছেলে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। জাগাবার চেষ্টা করলাম। কিছুতেই ঘুম ভাঙ্গলো না। বুঝলাম কোন মাদকদ্রব্য খাইয়েছে যাতে ঘুমিয়ে থাকে এবং ওদের মদের আসরে যেন বাধার সৃষ্টি না করে। আমার চোখে জল এসে গেল। চোখের জল সম্বরণ করে জিজ্ঞাসা করলাম - "সায়ন্তনকে কি খাইয়েছো?"
-- ঐ তো সেরেল্যাক।
-- "পেটে তো কিছুই নেই পেট ঢুকে গেছে, অথচ অকাতরে ঘুমোচ্ছে।" তারপর কলার চেপে ধরে বললাম - "বলো কি খাইয়েছো?"
কিছুতেই বলবে না, নিজের কথায় অনড়। তখন আমি সপাটে এক চড় মারলাম গালে। মদ খেয়ে ছিলো, প্রায় টলছিল। চড় খেয়ে টাল না সামলাতে পেরে মদের বোতল গ্লাসের উপর পড়ে গেল। ধরে তুলে কিল, চড়, ঘুসি দিয়ে বেদম মারতে লাগলাম। মুখে নাকে রক্ত বার করে দিলাম তবু আমার রাগ পড়ছে না। মেরেই চলেছি। তখন অরিত্র একটা মদের বোতল ভেঙ্গে আমার পেটে ঢুকিয়ে দিল। আমি পেটটা খালি করে নেওয়াতে বেশি ঢুকতে পারেনি।
সেই অবস্থাতেই এক লাথ মেরে দরজার বাইরে ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। খুব রক্ত
বের হচ্ছে, ডাক্তার দেখাতে হবে, সায়ন্তন ঘরে।
একা পারবো না, তাই বোনেদের ও আমার গানের টিমের ছেলেদের ফোন করলাম।
পাপ বিদায় করলাম লাথি মেরে। এবার স্বাধীন জীবন যাপন করবো। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।
0 Comments