Ad Code

.
.
1 / 8
2 / 8
3 / 8
4 / 8
5 / 8
6 / 8
7 / 8
8 / 8

অনাথ | কলমে ~ আমিরুল ইসলাম | নীরব আলো


রাত তখন ন'টা দশটা হবে রাস্তার ধারে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে বেঞ্চে বসে বসে পিডিএফ বই পড়ছিলাম। প্রায় রাতেই রাস্তার ধারে এমন ভাবে আড্ডা দিয়ে থাকি বন্ধুদের সাথে। তবে আজ ব্যাতিক্রম কেউ নেই। সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে গেছে। একাই বসে থাকতে ভালো লাগছে না তাই ভাবলাম হাঁটতে হাঁটতে পড়া যাক। পরিবেশটাও দারুন পূর্ণিমা রাত্রি তবুও জোনাকির টিমটিম চোখে পড়ছে। কোনোদিন এভাবে রাতের বেলায় আগে কখনো হাঁটা হয়নি। ইচ্ছে করছে হেঁটেই যায়, হেঁটেই যায়। হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার পাশের দুটো বাচ্চার দিকে। তারা এত রাতে এখানে কী করছে ? কেনই বা এভাবে বসে আছে? অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সব প্রশ্নের জবাব ওদের কাছেই পাওয়া যাবে তাই ওদের কাছে গেলাম। তারা দুজনেই জড়সড় হয়ে একটা চাদরের উপর কোনো রকম শুয়ে আছে। তারা ঘুমাই নি এখনও। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ওরা দুই ভাইবোন। ছোটো ছেলেটা বলছে দিদি রাত কখন ফুরাবে? ঠিক ঐ সময়ে আমি ওদের কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই তারা উঠে বসে পড়লো।তাদের চেহারায় একটা দারুন খুশির ঝলক পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তাদের এমন ভাব হওয়াতে আমি কিছুটা হলেও আশ্চর্য হয়ে ছিলাম। মেয়েটাকে বললাম
-বাবু তোমার নাম কী ?
খুবই মিষ্টি গলায় বলল - "আমার নাম...?"
হুম তোমার নাম।
- "রিংকি।"
আচ্ছা তুমি আমাকে দেখে এত খুশি হলে কেন? তুমি কি আমাকে চেনো? 
সে বলল- "জানো দাদা কোনো কোনো রাতে তোমার মত বড় লোকেরা এসে আমাকে অনেকসময় পাউরুটি, বিস্কুট, কলা দিয়ে যায়। আজ খুবই খিদে পেয়েছে..তোমাকে দেখে ভাবলাম তুমি আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছ।"
      একটা সাত-আট বছরের বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে আমার হৃদয়ে সজোরে একটা তীর ঢুকে যাওয়ার মত ব্যথা হলো। লজ্জায় দুঃখে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটি আবার বলল আচ্ছা দাদা গরীবের পেট কী খুবই বড়ো ? কেন এত খিদে পায়? তোমাদের তো কখনো শুনিনা খিদে পাওয়ার কথা! তোমরা কী খাও গো যে তোমাদের খিদে লাগে না?
      পাশ থেকে ছোটো ছেলেটি বলছে দিদি রাত কখন ফুরাবে? কখন খাবো ? খুব খিদে লেগেছে পেট ব্যাথা করছে! ঘুম আসছে না। খুব জোর হলে ছেলেটার বয়স পাঁচ ছয় হবে।এখন থেকেই সে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছে। পরিস্থিতি তাদের যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে এনেছে। ছেলেটাকে কাছে ডেকে বললাম - রাত আর বেশি দেরি নেই এই একটু পরেই সকাল। আচ্ছা বাবু রাতে কী ভয় লাগে? ছেলেটি কোনো উত্তর দিল না শুধু চোখে চোখে তাকাচ্ছে। আমি পারছি না তার করুণ ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। রিংকি বললো- "জানেন দাদা সেই সকালে খেয়েছি 
খুব খিদে লেগে আছে। ও ছোট্ট কিছু বুঝে না.. ও ভাবছে সকাল হলেই খেতে পাবো তাই সকালের অপেক্ষা করছে।" ছেলেটি কে এত খিদে লেগেছে যে সে কান্না করতে লাগলো।
রিংকি আমাকে আবার জিজ্ঞেস করছে -
"আচ্ছা দাদা গরীবের কী চোখে জল বেশি থাকে? তারা এত কান্না করে কেন ? আমাদের পেট অনেক বড়ো তবে খাবার নেই, আমাদের চোখে অনেক জল তবে মুছার কোনো মানুষ নেই? মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন দাদা ? আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছিলো আমার বড়োলোক কোনো মা বাবা। এক পাগলী আমাকে ওখান থেকে তুলে বড়ো করলো। তার মুখেই শুনেছি, এই ভাইকে দেখছ না? একেও কে ফেলে গেছিলো ওই ডাস্টবিনের ময়লা আবর্জনার সাথেই। ওই পাগলি মা আমাকে একটা ভাই এনে দিলো আজ পাগলিমাটা নেই। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গেছে। সরকারী দুটো লোক তার লাশটা নিয়ে গেছে।আমাদের দিকে তারা ফিরেও তাকালো না, এভাবেই থেকে গেলাম রাস্তায়।অনেক ভদ্র লোক আমাদের প্রায়ই খাবার দিয়ে যায়।খুব ভালো তারা,অন্তত আমার মা বাবার থেকে তো ভালো।তারা জন্ম দিয়েই আমাকে নোংরা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।"
একটা বাচ্চা মেয়ের এত অদ্ভুত বেদনাদায়ক প্রশ্ন থাকতে পারে এটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। রিংকি একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে, তার কথা শুনতে পাচ্ছি না আর। মাথার মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। কান্না রুখতে পারছিনা বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। রাস্তার পাগলিটাও আজ মা হতে হতে মারা গেছে । রাস্তার পাগলীটা কিভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয় ?
রাস্তার এদিক ওদিক দেখলাম কোনো দোকান খোলা নেই। আমার মাথায় একটা দোকানের কথা হঠাৎ মনে পড়লো অনেকদিন আগে একবার ওখানে খেয়েছিলাম তাদের দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। রিংকিকে বললাম এখান থেকে হেঁটে আট দশ মিনিট লাগবে মনে হয় যাবে আমার সাথে এক জায়গা?
খুব স্বাভাবিক ভাবে ধীর গলায় বলল- "কোথায় ?"
চলো আমার সাথে বলেই বাবুটাকে আমি কোলে তুলে নিলাম। জীবনে এত সুখ এত আনন্দ কখনো হয়নি যতটা আনন্দ এদের দুজনকে রেস্তোরাঁতে নিয়ে গিয়ে হলো। মেনু কার্ড থেকে যেকোনো খাবার পছন্দ করতে বললাম রিংকিকে কিন্তু সে এক কথায় বললো "দাদা গরীবের পেট এক থালা ভাত হলেই জুড়িয়ে যাবে।" ভাতে হাত দিয়েই যেন তারা স্বর্গের সুখ অনুভব করলো। খাওয়া শেষ করে ওদের আমার বাড়ি নিয়ে গেলাম। রাত ফুরিয়ে এলো আর মাত্র ঘন্টা খানেক। বেঁচে থাকা যে এত কঠিন, বাঁচতে গেলে ভাতের যে কত মূল্য রিংকিকে না দেখলে জানতেই পারতাম না।
পরের দিন সকালে অনাথ আশ্রমে ফোন করে ঠিকানা বলে দিয়েছিলাম। দশটা নাগাদ দুজন মানুষ এসে তাদের নিয়ে চলে গেলো।
তারা ওখানে অনেক সুখে ,খুশিতে আছে, প্রায়ই তাদের দেখতে যায়। আমাকে দেখে তারা ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে।
      এমন অনেক রিংকি আছে যাদের এক মুঠো ভাতের জন্য পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। পারলে তাদের সাহায্য করুন, দেখবেন ওদের খুশি দেখে আপনি কান্না ধরে রাখতে পারবেন না।


         ~ আমিরুল ইসলাম
© Copyright Protected

Post a Comment

0 Comments

Close Menu