এই আকস্মিক ব্যবহারে আমার মাথাটা যেন বেশ কিছু সময়ের জন্য বোধশক্তি হীন হয়ে গেল। চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার। কোনো রকমে বিছানার ওপর বসে পড়লাম। মনে হচ্ছিল যেন জ্ঞান হারাবো। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে লাগলো, চোখের সামনের অন্ধ কার মিটে যেতে লাগলো।
কিন্তু অভিলাষের রুঢ় কথাগুলো আমার কানে ঝাঁ ঝাঁ করে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে এখনো। "ডেড্ ইউ আর করোনা পজেটিভ্, এখন থেকে এই ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে হবে-ফর দি সেক অফ এন্টায়ার ফ্যামিলি।তুমি বুঝবে না কতটা সংক্রামক এই রোগটা ।কোয়ারেনটাইন থাকবে তুমি।"
কথাগুলো ভালোকরে বললেই হত। আমার ঘর, আমারই বাড়ি, অথচ আমিই গৃহবন্দি! পরিণত বয়সে কথাগুলো খুব কষ্ট লাগে। বুঝি সবই বুঝি, করোনা কন্টামিনেটেড, খুবই ছোঁয়াচে। তবুও আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতো।
নিজেরি প্রাসাদে নিজেই বন্দি! নিরুপায় হয়ে বিষাদ গ্রস্ত দেহ টাকে বিছানার ওপরে এলিয়ে দিলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অতীতের দিন গুলো মনে পড়ছিলো। আমার স্বপ্নের সেই সব দিনগুলো। একটি সমৃদ্ধ শিল্প নগরী স্থাপন করার ইচ্ছেটা আমায় নেশাগ্রস্ত করে রাখতো।তাই উপযুক্ত স্থান,পরিবেশ, জল, জমি, খনি খাদান এই সবের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতাম এদিক ওদিক। শেষে আজকের গড়ে ওঠা এই আকাশ শিল্প নগরীর জন্য জায়গা ফাইনাল হয়েছিল। এমনিতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো যা এই জায়গাটায় ভরপুর ছিল। এখানকার বন-বনানী, বেশ
খানিকটা সমতল বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ , ছোট্ট একটি নাম না জানা নদী, কাকলির গুঞ্জন, আবার রাতের অন্ধকারের নিঃশব্দ নীরবতা। আহ্,কি শান্তি ।
আর একটা আকর্ষণ ছিলো বনানী!
সেদিন পায়ে পায়ে ক্যাম্পের থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছিলাম। প্রকৃতির শোভায় আমি নিজেকে নিজের থেকেই হারিয়ে দিয়েছিলাম। কত সময় এভাবে কেটে গেছিলো খেয়াল করিনি। হঠাৎ বন ঝর্ণার কল কল নাদের মতো একটি যুবতীর কন্ঠস্বরে আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো। দেখলাম এক বনবাসী মেয়ে-বয়স খুব একটা বেশি না, ছিপ ছিপে গড়ন, শ্যাম বরণ গায়ের রং। সীমিত পোষাক কিন্তু কোনো অশ্লীলতা নেই, পিঠ ভর্তি খোলা চুল বাতাসে ফুর ফুর করে উড়ছে। একটি পাল ছাড়া ছাগ শিশুকে ধরার জন্য চিৎকার করতে করতে ধাওয়া করছে। অনেক ছোটাছুটির পর ছাগ শাবক টিকে ধরে ফললো মেয়েটি। পরিশ্রান্ত মেয়েটি দুষ্টু ছাগ শিশুকে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে শাসন করছিলো আর প্রান খুলে হাসছিলো-সত্যি যেনো বন ঝর্ণার কল কল নাদ!
- এই মেয়ে!
আমার ডাকে মেয়েটি আমার উপস্থিতি ঠাউর করে লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রয়াস করলো। ত্রস্ত হরিণীর মতো দৃষ্টি নামিয়ে বললো, আমাকে কিছু বললি বাবু?
- আহ্, সে যেনো কোকিলের সুর! বার বার শুনতে মন চাইছে। এবার মুখ খানা পরিস্কার দেখতে পেলাম। অবিন্যস্ত খোলা লম্বা চুল, ছোট্ট কপাল, কালো ভ্রমরের মতো দুটো চোখ, সরু ঠোঁট আর নিটোল খাড়া নাক। যৌবনের প্রাক কালে উপনীত একটি কালো কিন্তু আকর্ষণীয় বন বালা। জানিনা কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম সেই প্রকৃতিকন্যা ব্লাক বিউটি কে দেখে।
খুব নিচু গলায় মেয়েটি বললো-আমাকে কিছু বলছিলি বাবু?
আমার মনে হাজার প্রশ্ন কিন্তু আমি যেনো বোবা হয়েগেছি! কি যে বলবো ঠিক করতে পারছিনা। গলাটা যেনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
- "এই কি তবে সেই শকুন্তলা!"
আমি তবে ঘর যাচ্ছি বাবু, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। ছাগল গুলা পথ ভুলে অন্যদিকে চলে যাবেক আর এই ছাগল ছানাটাও ওর মায়ের জন্য উস্ খুস করছে।
ও চলে যাবে বুঝতে পেরে আমার মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। কেনো জানিনা মন চাইছিলো ও যেনো আমার পাশে এমনি বসে থাকতো।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো-তোমার নাম টা কি গো?
- নাম ? আমার নাম বনানী। সবাই আমাকে বনি বনি বলে ডাকে।
- বাহ্, খুব সুন্দর নামটা তো। কোথায় থাকো?
দূরের দিকে আঙ্গুল তুলে বললো, ঝাঁটি পাহাড়ির নিচে যে গেরামটা আছে সেই খানে আমাদের ঘর। আচ্ছা, আজ তবে আসছি।আমার মন চাইছিলো ওর সাথে আরো কিছু ক্ষণ কথা বলতে। বললাম বনানী, বাড়িতে আর কে কে আছে তোর?
- আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু, বান্ধবী সবাই আছে। আর আমার বাবা এই গাঁয়ের সর্দার। খুব ভালো, তবে বড্ড বেশী মদ খায় আর মাদল বাজায়। হাঁ, আর এক জন আমাদের গাঁয়ে থাকে, ঠিকাদার বাবু। ওকে আমার একদম ভালো লাগে না বাবু। না না করলেও বাবাকে জোর করে বেশি বেশি মদ খাওয়ায়।
- কেনো?
- ওর কাজ জঙ্গলের গাছ কাটার লোক দরকার। আমার বাবা সর্দার। তার লেগে বাবার খোসামদ করে। তা ছাড়া ওর আসল কথাটা আমি জানি, ও আমাকে বিহা করতে চায়।
আমাকে একটা বিছে কামড়ালো! অসহ্য একটা যন্ত্রণায় ছটপট করে উঠলাম। অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বললাম, বনানী তুমি কি ওই ঠিকাদার বাবু কে বিয়ে করতে চাওনা? তবে তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও ?
- আমি! আমার দিকে খানিক ক্ষণ চেয়ে থাকার পর বললো, আমি আমার মনের মানুষ কে বিহা করতে চাই, যে আমাকে খুব ভালোবাসবে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল প্রায় - আমাকে বিয়ে করবে বনানী? যাক্ খুব সামলে নিলাম। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, হচ্ছে টা কি?
- আচ্ছা, বাবু যাচ্ছি তবে রে, তোর সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল। বাবু, কালকে আবার আসবি, এই খানে ই দেখা হবেক্।
ওর চলেযাবার পথের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছিলো, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। দূর থেকে বাতাসে মাদলের সাথে বাঁশীর সুর ভেসে আসছিল। তার পর আর যেকটা দিন ওখানে ছিলাম, বনানীর সাথে দেখা করাটা যেন নেশায় পরিনত হয়ে গেছিলো। কোনোদিন দেখা না হলে ভীষণ কষ্ট পেতাম। জানিনা, তবে এটাকেই কি ভালোবাসা বলে!
কিছুদিন পর ফিরে এসেছিলাম। নানা কাজের ভেতরে জড়িয়ে পড়ে আস্তে আস্তে বনানীকে যেন ভুলে যাচ্ছিলাম। শিল্প নগরী বসানোর ভূতটা যেন সব ভুলিয়ে দিচ্ছিলো।কতো কাজ! সরকারি নিয়ম কানুন, ফাইনান্স, প্লান এপ্রুভাল, কনস্ট্রাকসান, র মেটেরিয়াল, লেন্ড টেকওভার আরো কতকি কাজের মাঝে আমি যেন নেশায় ডুবে থাকতাম। দেশ দুনিয়ার কোনো খবরই রাখতে পারতাম না।এর মধ্যে একদিন বর্ষার সাথে দেখা হয়। সে আমাদের প্রজেক্টের চীফ্ আর্কিটেক্ট।
উচ্চ শিক্ষিতা, কর্মঠ, শান্ত শিষ্ট কাজের মেয়ে।ধীরে ধীরে ও যেনো আমার মনে জায়গা করে নিচ্ছিলো। কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। দুই শরীর কিন্তু একটাই স্বপ্ন - আমাদের শিল্প নগরী। সময় ক্রমে গড়ে উঠলো বিশাল "আকাশ শিল্প নগরী" - আমাদের স্বপ্নের শহর।এ দিকে আমাদের সংসার ও বেড়ে গেলো। বর্ষা আমাকে একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলে উপহার দিলো -অভিলাষ। পড়াশুনায় খুব ভালো, তাই আমরা ওকে লন্ডনে পড়তে পাঠালাম। আমার পর ওই তো সব সামলাবে! পড়া শেষ করে ফিরে আসার পর বিয়ে দিয়ে দিলাম। একটি ফুটফুটে সুন্দর নাতিও হয়ে গেলো।
সব কিছু ভালোই চলছিলো। জানিনা কার নজর লেগে গেলো, বর্ষার কপালে এত সুখ ভোগকরার ছিলো না বোধা হয়, হঠাৎ একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।
আমি ভীষণ একা হয়ে গেলাম। বিষাদের চাদর মুড়ি নিয়ে পড়ে রইলাম একা একা। অভিলাষ কে সব দায়িত্ব দিয়ে একাকিত্বের অন্ধকারে ডুবে গেলাম। নিঃসঙ্গ বিষাদে ভরা দিন গুলিতে বর্ষাকে খুব মনে পড়ত। আমার সাথে সাথে প্রকৃতিও যেন পাল্টে যেতে লাগল। মেঘ, বৃষ্টি কোনো কিছুই ঠিক রইলো না। মেঘে জল নেই, খেতখামার সব জ্বলে পুড়ে গেলো।বিষাদের রাতে কার কান্না শুনতে পাই - তবে কি প্রকৃতি কাঁদছে? ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলাম। অভিলাষের কথা গুলো কানের পাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো বলে চলেছে, "ডেড্, ইউ আর করোনা পজেটিভ, তুমি নিজেকে এই ঘরের মধ্যে বন্ধ কোরে রেখো প্লিজ। তুমি জানো না এই রোগ টা কি ভয়ঙ্কর, ভীষণ কন্টামিনেটেড।"
বন্ধ দরজার ভেতরে নিজেকে আটকে রেখেছি, হোম আইসোলেসান, একান্ত বাস।বিছানায় পড়ে পড়ে হঠাৎ কেনো জানি না বনানীর কথা মনে পড়লো, ধূলি ধূসরিত উস্কো খুস্কো চুল, লোলিত চর্ম, নিস্তেজ নিস্প্রভ দৃষ্টি, বাঁকা কোমর, অস্পষ্ট কথা, "তুই আমাকে ভুলে গেলি বাবু!"
- আর্তস্বরে বললাম "একি! তোমার একিহলো বনানী?"জানালার পাশে উঠে গেলাম।
নষ্ট বাগানে আর কোনো রকম গাছপালা নেই, বাতাস নেই, বর্ষা তো আগেই চলে গেছে, বনানীও কোথায় হারিয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলাম নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছিলো এখনি যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে।
বনানীর সাথে অন্যায় করেছি, খুব কষ্ট হচ্ছিল!
পড়ে যাবার শব্দ শুনে সবাই ছুটে এলো। আমাকে বিছানায় তুলে ধরে শুইয়ে দিলো। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছৈ, ভীষন ভাবে হাঁপিয়ে পড়ছি। ওদের কথাগুলো আবছা আবছা শুনতে পাচ্ছিলাম, অভিলাষ অক্সিমিটার চেক করে বলছিলো, "অক্সিজেন লেবেল ফলিং, কল ফর এম্বুলেন্স!"
ওরা আমাকে হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছে। আমি এম্বুলেন্সের ভেতরে শুয়ে শুয়ে আবার বনানী কে দেখলাম, ও হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, বাবু শহর গড়তে গিয়ে বনানী কে শেষ করে ফেললি। শিল্প নগরীর নেশায়, সবুজের বলি দিলি বাবু! চাকচিক্যের ভিড়ে অরণ্য ধ্বংস করলি বাবু! বাতাসই তো জীবন সেটাও ভুলে গেলি বাবু! আর বাতাস কোথায় পাবি?
0 Comments