বলাই জেঠুর চায়ের দোকানে আগের রাতের চায়ের বাসি বাসন-- গেলাস, দুধের ডেকচি, চায়ের সসপ্যান, হাতা এই সব মাজছিল, আর জেঠুর মোবাইলে পনেরই আগস্টের দেশাত্মবোধক গান শুনছিল। জেঠু, খদ্দের কেউ না থাকলে বিদ্দে জেঠুর ভুলে ফেলে যাওয়া মোবাইলে লুকিয়ে লুকিয়ে নানা মনীষীদের জীবন কাহিনী শোনে। জেঠুটাও তেমন। সব ভুলে যায়। প্রায়ই মোবাইল ফেলে চলে যায়। বিদ্দের মাথাটা খুব পরিস্কার। একবার শুনলেই সব মনে থেকে যায়। স্কুল চালু থাকলে এ বছর ও সিক্সে উঠত। তিন বছর ধরে বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী। স্ট্রোক হয়ে পক্ষাঘাতে ডান দিকটা পড়ে গেছে। মা তবু সবজি বেচে, লোকের বাড়ি কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছিল, এখন করোনায় কাবু হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই বলাই জেঠুর হাতে পায়ে ধরে কাজ নিয়েছে। আসলে জেঠু কিছুতেই বিদ্দের মত স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে কাজে নিতে চাইছিল না। অল্পস্বল্প সাহায্য প্রতি মাসে করবেও বলেছিল, কিন্তু হাত পাততে বিদ্দের লজ্জা করে যে। বাবা, মা সমানেই খেটে খেয়েছে। এখন অবস্থার বিপাকে না হয় দুজনের কেউই কাজ করতে পারছে না। তাই বলে বিদ্দে লোকের কাছে হাত পাতবে? ওর খাটার মত নিজের দুটো হাত নেই নাকি ! তাছাড়া মায়ের চিকিৎসা, বাবার ওষুধ- এত টাকা কে রোজ রোজ দেবে? বিদ্দে ওর ছোট হাতে যা রোজগার করে তা হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, তবুও নিজের পরিশ্রমের উপার্জন তো। এতে আত্মসম্মান মিশে আছে।
বিদ্দে বাসন মাজতে মাজতে র্যালিটা দোকানের পাশ দিয়ে যেতে দেখল। সামনে বেশ কিছু বাচ্চা হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে দু বছর আগের ছোট হয়ে যাওয়া স্কুল ড্রেস পরা, তাদের চোখেমুখে আনন্দ। তার পেছনে লাল পাড় সাদা শাড়ির গুটি কয় মহিলা, তারপর কিছু লোক, মাঝে একটা বিদেশি দামি বাইক- একজন চালাচ্ছে আর একজন তার পেছনে বসে। বাইকের পরে আরও কিছু লোক। বিদ্দে জানে বাইকে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা মোটাসোটা লোকটা 'নবদল' পার্টির বিধায়ক অম্লান দে। বাবার টেলারিং-এর দোকানে আগে 'তোলা' তুলতে আসত। বিদ্দে স্কুল যাওয়ার পথে বাবার দোকানে এসে দু-একবার দেখেছে। বাবা ভয়ে একদম জড়সড় হয়ে থাকত। বিদ্দে গিয়ে পড়লে তাড়াতাড়ি দোকান থেকে পাঠিয়ে দিত। ওরা আজ 'সুভাষ স্মৃতি' ক্লাবের মাঠে পতাকা তুলতে এসেছে। র্যালিটা চলে যাওয়ার পরই দোকানের সামনেটা ঝাঁট দিতে গিয়ে বিদ্দে দেখে একটা পতাকা মাটিতে পড়ে গেছে। হয়ত কোনো বাচ্চার হাত থেকে পড়ে গেছে। এক্ষুনি কোনো বাইক বা সাইকেলের তলায় চলে গিয়ে পিষে যাবে। পতাকাটা তুলে নিয়ে দোকানের সামনে খুঁটিতে বেঁধে দেয়। বিদ্দের খুব ইচ্ছে করছিল ও ওই বাচ্চাদের মত ক্লাবের মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে স্কুলের হেডস্যার যেমন বক্তৃতা দেন, সেই রকম বড় মানুষদের বক্তৃতা শোনে, দেশাত্মবোধক গানে গলা মেলায়। বন্দে মাতরম বলে, জয় হিন্দ বলে কপালে হাত দিয়ে স্যালুট ঠোকে। তারপর লজেন্স-বিস্কুট হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
মাইকে এখন দেশাত্মবোধক গান ভেসে আসছে। বলাই জেঠু এখনো আসেনি। কোথায় গেল কে জানে ! এই মুহূর্তে জেঠু নেই, খদ্দেরও নেই। বিদ্দে দোকানের একটা বেঞ্চে উঠে একমনে চোখ বন্ধ করে কখনো হেড মাস্টারমশাই, কখনো সুব্রত মাস্টার মশাই, কখনো সুতপা দিদিমণি হয়ে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব বোঝাচ্ছে, ইতিহাস বলছে। আবার কখনো স্কুলের ছাত্র ছাত্রী হয়ে আবৃত্তি করছে, গান করছে-- এই ভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে ! হঠাৎ অনেকগুলো স্বর ওর সঙ্গে 'বন্দে মাতরম', 'জয় হিন্দ' বলাতে বিদ্দে চোখ খুলে লজ্জায় পড়ে যায়। সামনে অনেক লোক। রোজের কাস্টমার ছাড়াও ক্লাবের মাঠের লোকজন সবাই ওর কথা শুনছিল। ওদের মধ্যে পাঞ্জাবি পাজামা পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, "ওই ভুলে ভরা, উচ্চারণ দোষে দুষ্ট সস্তার নাম কেনার ভাষণের থেকে তোমার স্বাধীনতা দিবস পালন সত্যি আমাদের ভালো লেগেছে। অনেক বছর পর গলা ছেড়ে 'বন্দে মাতরম' 'জয় হিন্দ' বললাম। নাহলে এত সুন্দর কথা দুটো মুখস্থ বুলির মত বলে যেতাম। মনের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছত না।"
প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার মশাই অরিন্দম বাবু ওকে কোলে তুলে বললেন, "বুঝলেন প্রফেসর সান্ন্যাল, বিদ্যাসাগরের মত ছাত্ররা থাকলে দেশটা একদিন সত্যি স্বাধীন হবে। তোমার ইচ্ছে করে মোবাইল ফেলে যাওয়া মাঠে মারা যায়নি। বিদ্দে যন্ত্রটার সঠিক ব্যাবহারই করেছে।"
উপস্থিত জনতা সমস্বরে বলে উঠল 'বন্দে মারতম'
'জয় হিন্দ'। তারপর সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করল-
'জনগন মন অধিনায়ক জয় হে....
সেই সময় ছত্রভঙ্গ মিছিলটা আসতে দেখা গেল। দ্রুত ফিরতে চাওয়া দামি বাইকের গর্জন এত লোকের গানের সমিল্লিত আওয়াজে চাপা পড়ে গেল।
0 Comments