চৌধুরীবাড়িতে মেজবৌ হিসেবে পা রেখেই ঝর্না বুঝতে পেরেছিল এই বাড়ির অতীত গৌরবের কথা। বাড়ির পূর্ব পুরুষরা অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, অনেকে জেলও খেটেছেন। ভাষা শহীদদের সাথেও নিবিড় সখ্যতা ছিল। বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা পুরানো জিনিস, উঁচু উঁচু দালান, গম্ভীর আসবাব পত্র, পুরানো ঝাড়বাতি সেই সবকিছুর স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে। নোনা ধরা দেওয়াল, ছড়ানো চাতাল, দুর্গা মণ্ডপ অথবা জীর্ণ ইঁটের আঁকে বাঁকে লেখা আছে সেই সব আত্মত্যাগী বীর যোদ্ধাদের দেশাত্মবোধর কাহিনী, যা পরিবারের সকলকে এক বিশেষ মর্যাদা দান করে আসছে বহুদিন ধরে।
পনেরোই আগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারী কিংবা নেতাজীর জন্মদিন, গান্ধী বার্থডে আসলেই সেই আবেগের ভিসুভিয়াস আবার ঝলসে ওঠে নতুন করে। শুধু তাই নয় একুশে ফ্রেব্রুয়ারীতে কবিতা পাঠ হয়। নববর্ষের দিনে পাঞ্জাবী, শাড়ির খসখস শব্দে, পঁচিশে বৈশাখের দিনে কবিগুরু যেন স্বয়ং বিচরণ করেন এ বাড়ির চাতালে। আবার জ্বালামুখী জৈষ্ঠ্যতে হয় নজরুল বন্দনা। মননে রবি ঠাকুর, আর চেতনায় বিদ্রোহী কবি।
* * * * *
তখন আষাঢ় মাস পড়তে আর ক'দিন বাকি। মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বাংলাদেশ বর্ডার ঘেঁষা এক অখ্যাত গ্রামের হত দরিদ্র পরিবার থেকে একটা মেয়ে চৌধুরীবাড়িতে পা রাখল। সপ্তাহ দুই যেতে না যেতেই পরিবারের অনেকের বিরাগভাজন হল সেই মেয়েটি। একেই গায়ের রং চাপা খুব সুন্দরীও নয়। আর্থিক অবস্থাও তেমন মানানসই না। শাশুড়ির রোষানলে পড়তে তাই বেশীদিন সময় লাগেনি। উঠতে বসতে কারণে অকারণে খোঁটা দিতে শুরু করলেন তিনি।
"মেজ বৌমা, সারাদিন তো তেমন কোন কাজ নেই তোমার। তা একটু বড় বৌমার কাছে ইংরাজীটা শিখলেই তো পারো। সময় কাটবে কিছু শেখাও যাবে।"
-- "মা, এই সংসারে এসে এখন কি আর নতুন করে লেখাপড়া করার সাধ জাগে মনে। আর সংসারে কে বলেছে কাজ নেই? প্রচুর কাজ। তাছাড়া সময় কাটানোর অনেক উপায় আছে। ইংরাজী না শিখলেও চলবে।"
-- "তোমার এই একটাই দোষ। কিছু বলতে গেলেই দুচার কথা শুনিয়ে দাও। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে বলছিলাম বৌমা, জানো তো এই বাড়ির অতীত গৌরবের কথা। সকলেই লেখা পড়ায় বেশ ভাল, উচ্চ শিক্ষিত। ইংরাজীতেও বেশ পোক্ত। তাছাড়া বাড়িতে মাঝে মাঝে অনেক বিদগ্ধ, জ্ঞানী লোকের পা পড়ে। ওঁদের সাথে সড়গড় হতে গেলে একটু আধটু ইংরাজী না জানলে হয়!"
-- "মা, কি যে বলেন! বাংলাটাই গুছিয়ে ঠিক মত বলতে পারি না। তার পরে আবার ইংরাজী শিখতে গেলে সব কিছু গুলিয়ে যাবে।"
শাশুড়ি মা ঝর্নার কথা শুনে আর কথা বাড়ান না, গম্ভীরভাবে পুজোর ঘর চলে যান।
প্রতি বছর বাড়িতে বিভিন্ন মাসে অনেক অনুষ্ঠান হয়। এই যেমন মার্চে দোলোৎসব, এপ্রিলে নববর্ষ, মে মানে বৈশাখ মাসে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে কবিতা পাঠ। আগষ্ট মাস মানেই স্বাধীনতা দিবসের মাস। সেখানে উৎসবের বহর একটু যেন বেশী। তার উপর এই মাসে অনেক ছোট ছোট পরব আছে- জন্মাষ্টমী, রাখী পূর্ণিমা, ঝুলন। তাই অনুষ্ঠান অসলে পরিবারের সকলের কাজের চাপও বেড়ে যায়। অনুষ্ঠান পরবের সবটাই বড়বৌমা এতদিন সামলে এসেছেন। উনি শিক্ষিতা, স্মার্ট, সমাজে সবার সাথে মিশতে পারেন। মেজ বৌমা আসাতে বড় বৌয়ের চাপ কিছুটা হলেও কমতে পারে। ঝর্না বড়র পাশে থেকে থেকে একটু একটু করে কাজ শিখছে। এবারে পনেরোই আগস্টের দিন শুনেছে বাড়িতে নাটক হবে। ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈকে নিয়ে নাটক। বড়বৌমা অরুণাই লক্ষীবাঈয়ের রোলটা করবে। বাড়ির অনেক সদস্যরাও এতে অংশগ্রহণ করছে।
ঝর্না রোজ রাতে দেখে বড়জা নাটকের সংলাপ বলছে। দুর্গা দালানের চাতালে দাঁড়িয়ে মা দুর্গার একটা তরবারি নিয়ে লক্ষীবাঈয়ের মতন ঘোরাচ্ছে। ঝর্নার ভীষণ ইচ্ছে নাটকে যোগদান করার। কিন্তু শাশুড়ির মা পাছে রাগ করেন তাই সাহস করে কিছু বলেনি। তাছাড়া উনি ঝর্নাকে অতটা পছন্দ করেন না।
একদিন শ্বশুর হরিমোহনবাবু গভীররাতে দেখলেন ঝর্নার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরে উঁকি মারতেই উনার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। দেখলেন ঝর্না বই পড়ছে, আর মাঝে মাঝে নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করছে। দু চারটে ইংরাজী বইও আছে পাশে।
"বল বীর
চির উন্নত মম শির
...... .....
শিখর হিমাদ্রীর।"
শুনে হরিমোহনবাবুর চোখ টসটস করে উঠল। মাঝে মাঝে অনেক রাতে উনি ঝর্নার পাঠ করা ইংরাজী কবিতাও শুনতে পান। যেমন কোন কোন দিন জীবনানন্দ দাশের ইংরাজীতে লেখা কবিতা। উনি ভাবতেই পারেন নি হাভাতে পরিবারের মেয়ে হয়ে ঝর্না এতটা....
দেখতে দেখতে আগস্ট মাস পড়ল। চৌধুরী বাড়ি সেজে উঠল নতুন করে। দিন যত এগোচ্ছে বাড়ির মানুষদের আবেগের পারদ তত চড়ছে। এদিকে রমজান মাস পড়ল। দুদিন যেতে না যেতেই প্রবল বর্ষণে মসজিদে জল উঠল। একেই রোজার মাস নামাজ পড়ার অসুবিধা, তার ওপর মসজিদ চত্বরে জল থৈ থৈ করছে। হরিমোহনবাবুর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ঝর্নাই সব পথ বাতলে দিল।
-- "বাবা, দুর্গা দালানটা তো ফাঁকাই আছে। ওখানেই নামাজ পড়বে।"
-- "মা , বুঝলাম সব। কিন্তু নাটকের মহড়া, কবিতা, গানের অনুশীলন তো দালানেই চলছে। তার কী হবে?"
-- "ইফতারের আগে নাটকের মহড়া চলবে। তারাবি নামাজ শেষ হলেই চলবে গান কবিতা।"
-- "বাহ ! দারুণ বলেছো।"
-- "বাবা, ভুলে যাবেন না, দেশটার নাম ভারতবর্ষ।"
* * * *
পনেরোই আগষ্ট আসতে তিন দিন বাকি। যিনি লর্ড ডালহৌসির পাঠ করবেন তিনি হঠাৎ ভাইরাল ফিবারে আক্রান্ত হলেন। এদিকে নাটকের সব কিছু তৈরী। হরিমোহনবাবুর কলকাতার অনেক বন্ধু বান্ধব আসছেন চৌধুরীবাড়ির অনুষ্ঠান দেখতে। উনি নিজেও বেশ টেন্সড্। সব শুনে ঝর্নখ সমাধানের এক রাস্তা বার করল। হরিমোহনবাবু ঝর্নার প্রস্তাবটা মেনে নিলেন। তবু একটু সংশয় থেকেও গেল। নিজের জাঁদরেল স্ত্রীকে তো বিশ্বাস নেই, কখন যে কি করে বসেন!
পনেরোই আগস্টের দিন সকাল থেকেই চৌধুরীবাড়িতে অনুষ্ঠান। ভিড় উপচে পড়ছেছে। এদিকে শাশুড়ি রেগে ফায়ার, ঝর্নার সকাল থেকেই দেখা নেই। কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে নাকি গেছে, উনি অসুস্থ তাই। দেখতে না পেয়ে সারা বাড়ি চেঁচিয়ে মাত করছেন শাশুড়ি, "মেজ বৌমার আক্কেল বলিহারি! বাড়িতে অনুষ্ঠান আর উনি বেপাত্তা। আজ আসুক, দেখাচ্ছি মজা।"
-- "কী হল মাসিমা, অত চেঁচাচ্ছ কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে। কাজ ঠিক সামলানো যাবে।"
-- "চেঁচাব না তো কি তোমার বৌদিকে পুজো করব? দেখছ না কত কাজ জমে আছে!"
বিকেলের পরে বৃষ্টি কমলেও বুড়ির রাগ কমেনি। ঝর্নার উপর তেলে বেগুনে জ্বলে আছেন। সন্ধ্যের একটু পরেই শুরু হল নাটক "ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈ"। বড়বৌমা লক্ষীবাঈয়ের রোলটা অসাধারণ করছে। চারিদিক থেকে প্রশংসার বন্যা। একটু পরেই মঞ্চে আসল লর্ড ভালহৌসী। একেবারে সাহেবী ঢংয়ে। গা দিয়ে ইংরাজির গন্ধ বেরোচ্ছে। পরনের কালো কোট আর দাম্ভিক বুট জোড়াতে তার পূর্ণ প্রতিফলন। এত নিখুঁত ইংরাজীর উচ্চারণ এ তল্লাটে তো বটেই, হরিমোহনবাবুর বন্ধুরাও শোনেননি। শরীরের পরিভাষাতেও যেন সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ফুটে উঠছে। ডালহৌসি "Doctrine of Lapse" এর বলে ঝাঁসী দাবী করছে। ওদিকে বড়বৌমা "লক্ষীবাঈ" গর্জে উঠল, "মেরী ঝানসী নেহী দুঙ্গি, মেরী ঝাঁসি......"।
তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ছে দুর্গা দালান সহ সারা মাঠ। শাশুড়ি ভালহৌসীর ঐ সাম্রাজ্যবাদী নীতি দেখে প্রবল অসন্তোষে ফেটে পড়লেন। মনে মনে গালাগালিও দিলেন কয়েক প্রস্থ।
* * * *
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। চৌধুরীবাড়ি আর সেভাবে কোন অনুষ্ঠান বা নাটকের আয়োজন করেনি। কোন মাসেই সেইভাবে মাইক ঝলসে ওঠেনি। দুর্গা দালানটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এক অপার শূন্যতা।
একদিন মহালয়ার ভোরে শ্বাশুড়ি ছলছল চোখে দুর্গাদালানে এসে দাঁড়ালেন। বুকের মধ্যে লুকোনো "ভিসুভিয়াস" যেন দপদপ করছে। তাতে একটুও মরচে ধরেনি। মা দুর্গার শরীরে সবে রংয়ের প্রলেপ পড়ছে। মুখে শিউলি ফোটা ভোরের মতন স্নিগ্ধ হাসি জ্বলজ্বল করছে। শ্বাশুড়ি দেখলেন মা অদ্রিজা ঠিক যেন ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীর মতন দণ্ডায়মান। ঝলসানো হাসিমাখা চোখ মুখে কেমন একটা "ডালহৌসী"র ভাব রয়েছে, দীপ্ত তেজ রয়েছে। শুধু সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সাটুকুই নেই।
চৌধুরীবাড়ির বহু বছর আগে নাটকে পাঠ করা সেদিনের "লর্ড ডালহৌসী" মেজ বৌ ঝর্না ক্যানসারের টগবগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেছে আসল "ডালহৌসী"র দেশে। তবু তাকে নিয়ে গল্প শেষ হয়নি। আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে, গ্রাম ছাড়িয়ে শহরে। শহরের ধুলো মেখে আরো বড় শহরে, কলকাতাতে।
শাশুড়ি রেডিও চালালেন মহালয়া শুনবেন বলে। বৃদ্ধ হরিমোহনবাবুর বাই ফোকালে শরৎ শিশিরের চন্দন। রেডিওতে বাজছে জোর কদমে.....
"জাগো দুর্গা.......
.......জাগো......
তুমি......."
হরিমোহনবাবু তন্ময় হয়ে মহিষাসুরমর্দিনীতে ডুবে আছেন। ওনার সাজানো সংসারের "মা উমা"র কথা মনে পড়ছে। যিনি না থেকেও আজ আছেন, সর্বত্র বিরাজমান। ঠিক "লর্ড ডালহৌসী"র মত। গোটা ভারতবর্ষকে ছুঁয়ে গেছেন। সংসার নামক ভারতবর্ষে ঝর্না যেন তার এক সংস্করণ।
জমিদার হরিমোহনবাবু স্মৃতির বাল্টিক সাগরে অবগাহিত হচ্ছেন একটু একটু করে। চোখে যেন পশ্চিমীঝঞ্ঝার কোটাল। ওনার সিক্ত চোখের সামনে ভাসছে বহু বছর আগে রাসের মাঠে ঝর্নার ফাল্গুনী রোদে তেতে পুড়ে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবার ঘটনা। সেই দিনটা ছিল ৮ই মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। গরীব ঘরের কালো মেয়েটা সেদিন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যেন নারী স্বাধীনতার জেহাদ ঘোষণা করেছিল। বুঝিয়েছিল "আমরা নারী, আমরা পারি"। তখনকার দিনে মানুষ নারী দিবস নিয়ে অতটা ওয়াকিবহাল ছিল না, আজ যেমন সমাজ দেশ একটু একটু করে সাবালক হয়েছে।
নেপথ্যের কারিগর ঝর্না। ও-ই উদ্যোগ নিয়েছিল নারী দিবস পালন করার। শুরুতে বাঁধাও এসেছিল, তবে সব প্রতিকূলতার মেঘকে দূরে সরিয়ে মেয়েদের উপর জোর করে চাপানো তালিবানী শাসনের ফতোয়ার বিরুদ্ধে হেনেছিল প্রতিবাদী জেহাদ। পিষে ফেলতে চেয়েছিল সংসারে নারীর লাঞ্ছনা, অপমান। এ যেন আর এক "Doctrine of Lapse" এর নামান্তর, ভাবান্তর বা ভাষান্তর রূপক অর্থে।
মহালয়া অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কালো অমাবস্যার বৃন্ত চিরে বেরিয়ে আসছে নতুন ভোর। পরিণত ভোরের সোনামুগ রোদ্দুরে ঠাকুর দালানে মা গৌরীর স্বর্ণাভ মুখটা দেখে শাশুড়ি দু হাত তুলে কোঁচকানো কপালে ঠেকালেন। শরতের আকাশে তখন পেঁজা তুলোর মতন টুকরো টুকরো মেঘেদের দস্যিপনা শুরু হয়েছে। মেঘের দেশে যেন সাম্রাজ্যবাদ। এক একটা মেঘ যেন ছোট ছোট অঙ্গ রাজ্যের ক্ষুদ্র সংস্করণ। আর তার অনতিদূরেই একটা ছোট মেঘ যেন এক ঘোড়োসওয়ারের আকার নিয়েছে। ঘোড়ার লেজটা দুলছে ঠিক যেন "লর্ড....."
~ কবিরুল
© Copyright Protected
0 Comments